‘সব কথা বলতে পারি না, মুখে তালা লাগিয়ে থাকতে হয়’

সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাস
প্রথম আলো ফাইল ছবি
সিলেট শহরের টিলাগড় এলাকায় অবস্থিত মুরারি চাঁদ কলেজ (এমসি কলেজ)। ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজটিতে প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। গত শুক্রবার রাতে ঐতিহ্যবাহী এই কলেজ ক্যাম্পাসে বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক তরুণী। তাঁকে এই কলেজেরই ছাত্রাবাসে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। যাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তারা ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে পরিচিত। এসব বিষয়ে আজ রোববার সকালে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন কলেজ অধ্যক্ষ মো. সালেহ আহমদ। তিনি ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর অধ্যক্ষ পদে কলেজে যোগ দেন। এর আগে তিনি একই কলেজে উপাধ্যক্ষ পদে ২০১৮ সালের ৭ এপ্রিল থেকে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর সিলেট প্রতিনিধি সুমন কুমার দাশ

প্রশ্ন :

আপনার কলেজের ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটল। এ বিষয়ে কী বলবেন?

অধ্যক্ষ : শুরুতেই বলতে চাই, ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কালপ্রিটেরা (গণধর্ষণকারী) ধরা পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনো সবাইকে ধরতে পারেনি। এটা নিয়ে ফলোআপ করছি। পুলিশ-র‌্যাবের সংশ্লিষ্টদের ফোন দিচ্ছি, যোগাযোগ রাখছি। এদের ধরার পরেই মূলত আমি যাই বলি না কেন, সেটা ফলপ্রসূ হবে। এ ঘটনায় বিব্রত, লজ্জিত সবাই বলছি আমরা। কিন্তু আসামিরা আগে ধরা পড়ুক, এরপর অন্য বিষয়ে কথা হবে।
অনাকাঙ্ক্ষিত যে ঘটনা ছাত্রাবাস চত্বরের ভেতরে ঘটেছে, সন্ধ্যার পর অর্থাৎ রাতের বেলা এটি ঘটেছে। এটাতো আকস্মিক ঘটেছে। আমরা ক্যাম্পাসে ছিলাম, তখন ঘটনাটি ঘটেছে, বিষয়টি কিন্তু তা না। কিন্তু পুরো বিষয়টিতে আমরা লজ্জিত। শুধু একজন অধ্যক্ষ হিসেবে নয়, একজন বাবা হিসেবে আমি বলতে চাই, এই তরুণীর পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। আমরা আজ রোববার কিছুক্ষণ পর মেয়েটির কাছে যাব। তাঁকে সাহস দেব, এখন তাঁর কাউন্সেলিং দরকার। এই ভিকটিমের পরিবারের এখন সাপোর্ট দরকার। এটার জন্য আমি যাচ্ছি আমার সহকর্মীদের নিয়ে। তাঁদের বাসায় যাব, বোঝাব তাঁরা যেন ভয় না পায়, আমরা তাঁদের সঙ্গে আছি। সবই আমরা করলাম, কিন্তু আসামিদের সব যদি ধরা না পড়ে, তাহলে প্রশ্ন থেকে যাবে! আমাদের কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অনেকেই ফেসবুকে (সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম) এ বিষয়ে লিখছেন। বিষয়টি টক অব দ্য কান্ট্রি। তাই দ্রুততার সঙ্গে দোষীদের গ্রেপ্তারের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। এদের ধরে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এরপর বিচার করতে হবে, বিচারে আস্থা আনতে হবে। বিচারহীনতার যে বিষয়টা, এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নারীর প্রতি যে সহিংসতা, এটা তো সর্বত্র চলছে। আমার প্রতিষ্ঠানেও এমনটা ঘটল। এখন, এরা (গণধর্ষণকারীরা) যদি ছাত্রাবাসে না গিয়ে অন্য জায়গায় যেত, তাহলেও তো ঘটনার ভয়াবহতা একই রকমেরই থাকত। এখন, আমার ছাত্রাবাসের গেটটা খোলা পেয়েছে, গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়েছে। হোস্টেলের ভেতরের রাস্তায় অন্ধকার ছিল, সেই সুযোগটা ওরা নিয়েছে। এখনো সবাই ধরা পড়েনি। নিশ্চয়ই একদিনের ব্যবধানে ওরা দেশ ছেড়ে চলে যায়নি। ওদের ছবি এখন ভাইরাল হয়ে গেছে। প্রত্যেক দোষী গ্রেপ্তার হোক, এটাই এখন চাই।

প্রশ্ন :

আপনি বিচারহীনতার সংস্কৃতির কথা বললেন। এর আগেও এমসি কলেজে একাধিক দুর্বৃত্তপনা ঘটেছে। আগুন দিয়ে কলেজ ছাত্রাবাস পোড়ানো, শিক্ষককে মারধর থেকে শুরু নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে কলেজের শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। কিন্তু কারও বিরুদ্ধেই বিচার তো দূরের কথা, কলেজ কর্তৃপক্ষ যথাযথ উদ্যোগ পর্যন্ত নেয়নি। এ বিষয়টা কী তাঁদের কর্মকাণ্ড-কে প্রশ্রয় দেওয়া নয়?

অধ্যক্ষ : দেখুন, আমি তো সব কথা বলতে পারি না। আমার মুখে তালা লাগিয়ে থাকতে হয়। অনেক কিছু আছে আমরা বলতে পারি না। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে বলতে পারি না। ২০১২ সালে হোস্টেল পুড়িয়ে দেওয়ার পর ৬ কোটি টাকা খরচ করে নতুন ভবন নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পোড়ানোর ঘটনার বিচার তো হয়নি। সেদিন ছাত্রলীগ ও ছাত্র শিবিরের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। কারা ছাত্রাবাস পুড়িয়েছিল, সেটা প্রমাণের বিষয়, এ নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। তবে যারাই ছাত্রাবাস জ্বালিয়েছে, তাদের বিচার তো হওয়া প্রয়োজন। প্রকৃত দোষীদের বিচার হোক। তখন অন্যরা বুঝতে পারবে, দোষ করলে বিচার হবে। তবে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে এখন এ-সংক্রান্ত কেসটা আছে।

প্রশ্ন :

দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ছাত্রাবাসের দুজন নিরাপত্তাকর্মীকে বরখাস্ত করেছেন। তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে। এ বিষয়ে যদি কিছু বলতেন।

অধ্যক্ষ : দুজন নিরাপত্তাকর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এখন দেখছি, এটা নিয়েও ফেসবুকে সমালোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ওরা নিরীহ মানুষ, ওদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। তাহলে কেন তাঁদের বরখাস্ত করা হলো। দেখুন, মানবিকতা দেখালেও সমস্যা, না দেখালেও সমস্যা। আসলে তাঁদের বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলা পেয়েছি বলেই আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন, গত শুক্রবার যে ঘটনা ঘটল, সেটা তো তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে ছাত্রাবাসের দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীদের জানানোর কথা ছিল। কিন্তু তাঁরা তা জানায়নি। জানতে পেরেছি, ওরা নাকি তখন ঘটনাস্থলেই ছিলেন না। আবার অনেকে বলছেন, তারা (নিরাপত্তাকর্মী) থাকলেই কী করতেন? তাঁরা তো তাদের (গণধর্ষণকারী) আটকাতে পারত না। সেটা ঠিক তারা আটকাতে পারতেন না, কিন্তু আমাদের ইনফর্ম তো করতে পারতেন।
তরুণীর স্বামী থানায় যে মামলা করেছেন, সেখানে ছয়জনের নাম উল্লেখ আছে। এর মধ্যে একজনের ছাত্রাবাসে সিট বরাদ্দ ছিল। যেহেতু তার নামে অভিযোগ এসেছে, তাই সাময়িকভাবে তার সিট বাতিল করা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে তার সিট চূড়ান্তভাবে বাতিল করা হবে এবং তার ছাত্রত্ব বাতিলের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করা হবে। মামলার তিনজন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। বাকি দুজন বহিরাগত। সার্বিক বিষয়ে তদন্ত চলছে। তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে গতকাল শনিবার। ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তারা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে। এরপর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সালেহ আহমদ
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

গণধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে এর আগেও ছাত্রাবাস ও কলেজ ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তার এবং বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের অভিযোগ ছিল। তাঁদের দ্বারা ছাত্রাবাসে জুয়ার আসর বসানোর অভিযোগও উঠছে। তাহলে কলেজ কর্তৃপক্ষ তখন কেন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি?

অধ্যক্ষ : জুয়ার আসর বসানোর কোনো অভিযোগ আমরা তখন পাইনি। তবে কলেজ ছাত্রাবাসে তাঁদের সিট না থাকলেও মাঝে মধ্যে গিয়ে তাঁরা ছাত্রাবাসে থাকত, এমন তথ্য পেতাম। এটি শুনে আমরা তাঁদের একাধিকবার ডেকেছি, থাকার কারণ জানতে চেয়েছি। তখন তাঁরা বলত, ‘স্যার, মাঝেমধ্যে যাইটাই। ওখানে আমাদের বন্ধুরা থাকে।’ এখানে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের মতো অবস্থা না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে যে কর্মকাণ্ড- হয়, এখানে কিন্তু সেসব হয় না। এখানে সিট বাণিজ্য নেই। আমরাই মেধার ভিত্তিতে সিট দিই। কিন্তু জিজ্ঞেস করলেই তারা বলে, ‘আমার বন্ধু থাকে। তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।’ দিনে থাকে না, রাতে গিয়ে বন্ধুর রুমে থাকছে, এটুকু জানি আমরা। আমরা সার্বক্ষণিক এগুলো মনিটরিং করি। এখানে নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষার্থী থাকে, হলের মতো হাজার হাজার শিক্ষার্থী থাকে না। একেবারে হাতেগোনা ৩০০ জন শিক্ষার্থী থাকে। আমরা প্রতিটি রুমে মনিটরিং করি। যাদের সঙ্গে ওরা (গণধর্ষণকারী) এত দিন চলাচল করেছে, এখন তারাই এদের বিরুদ্ধে নানা তথ্য দিচ্ছে, অভিযোগগুলো জানাচ্ছে। অথচ এরাই এত দিন কিছু বলেনি, বরং তাদের সমর্থন করেছে।

প্রশ্ন :

আপনাদের ভূমিকা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। কেউ কেউ পদত্যাগের দাবি করেছেন। অনেকেই বলছেন, অধ্যক্ষ কিংবা কলেজ প্রশাসনের আরও তৎপরতার প্রয়োজন ছিল। এ ঘটনায় আপনাদের দায় কতটুকু?

অধ্যক্ষ : দেখুন, ঘটনাটি ঘটেছে রাতে, সাতটায়। দিনের বেলা ঘটেনি। সাতটা সময় আমি বাসাতে থাকি। তখন তো আর অফিসে থাকি না। সারা দিন আমি কলেজে কাজ করে তখন বাসায় রেস্ট নিতে যাই। সেদিন আমার শরীরও খারাপ ছিল। সন্ধ্যা সাতটার সময় নিশ্চয়ই আমার বাসায় থাকার কথা। তবে বাসায় থাকলেও ২৪ ঘণ্টাই আমি দায়িত্ব পালনের মধ্যেই থাকি। হোস্টেল সুপার কিংবা কর্মচারীরা আমাকে কোনো বিষয়ে জানালে আমি তাৎক্ষণিকভাবে ছুটে যাই। কিন্তু আমাকে যদি নিরাপত্তাকর্মীরা ইনফর্ম না করেন তাহলে খবর পাব কীভাবে? আসলে ওইসময় নিরাপত্তাকর্মীরা ওখানে ছিলেন না। বিষয়টি আমাকে পুলিশ জানিয়েছে। এরপর আমি তাদের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাই। বিষয়টি র‌্যাবকেও অবহিত করি।
করোনাভাইরাসের পর থেকে এখন পর্যন্ত কলেজ বন্ধ আছে। যদিও ছাত্রাবাস বন্ধ, কিন্তু কিছু শিক্ষার্থী টিউশনি করত, মানবিক কারণে তাই হোস্টেলে ২৫ জনকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। এখন এ ঘটনার পর সবাইকে ছাত্রাবাস ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। অলরেডি সবাই চলেও গেছে। কলেজ বন্ধ থাকলেও প্রতিদিন আমি ক্যাম্পাসে এসেছি, অফিস করেছি। আমি অন্যান্য সহকর্মীদের বলেছি, আপনার অনলাইনে ক্লাস নিন, তবে মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসে আসেন, খোঁজখবর নেন। এখন বলেন, এত বড় একটি ক্যাম্পাস, এই করোনাপরিস্থিতিতে একা আমার পক্ষে দেখভাল করা সম্ভব? আমি একা কত করব? উপাধ্যক্ষ একা কত করবেন? অনেক কষ্ট আছে, দায়িত্বে বসে সবকিছু তো আর বলা যায় না।

প্রশ্ন :

ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে কলেজ ক্যাম্পাসে অবৈধ আধিপত্য বিস্তার, ছাত্রীদের ইভটিজিং, বিকেলে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টাকা-মোবাইল ছিনতাই এবং মাদক সেবনসহ নানা অভিযোগ উঠছে। দীর্ঘদিন ধরেই নাকি এমনটা চলে আসছে। এসব বিষয়ে কী বলবেন?

অধ্যক্ষ : দেখুন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কলেজ চালু হলে এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হবে। এখানে সবাই ছাত্র, এটাই তাদের একমাত্র পরিচয়। একজন দোষী ও অপরাধী ব্যক্তিকে তার অপকর্মের দায় নিজেকেই নিতে হবে। যখনই ক্যাম্পাসে ছিনতাই কিংবা অন্য কোনো অপকর্মের অভিযোগ পেয়েছি, তখনই ব্যবস্থা নিয়েছি, নিচ্ছি।
আবার এটাও ঠিক, অনেকে সন্ধ্যার পর নীরব হয়ে যাওয়া কলেজে অবস্থান করেন। সেখানেও দর্শনার্থীদের সচেতন হতে হবে। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করতে পারেন যে কেউ, কিন্তু সন্ধ্যার পর এখানে থাকা ঠিক নয়। যাঁরা বেড়াতে আসেন, তাঁদের অনেককেই দেখি ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে কলেজের পার্শ্ববর্তী টিলাতেও যান। এটাও তো ঝুঁকিপূর্ণ। এসব বিষয়েও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কলেজ এলাকায় পুলিশি টহল আরও বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানাব।