সব বাধা পেরিয়ে

অনেক গ্রামেই মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করছে। ছবি: প্রথম আলো
অনেক গ্রামেই মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাতায়াত করছে। ছবি: প্রথম আলো

নভেম্বর মাসের একটি মনোরম, রোদেলা সকাল। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী প্রত্যন্ত উপজেলা সন্দ্বীপের একটি স্কুলের অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। সেখানে বিরতির সময় যখন প্রধান শিক্ষকের ঘরে বসে চা খাচ্ছিলাম, তখন সপ্তম শ্রেণির এক মেয়ে আমার কাছে এসে বসল। আমি তার গ্লাসে পানি ঢেলে দিতে চাইলে সে বলল, ‘আন্টি, আমাকে আধা গ্লাস পানি দিন। ’ স্বাভাবিক কৌতূহল থেকেই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন? ’ তখন সে বলল, ‘১৬ কোটি মানুষের এই দেশে আমরা যদি প্রত্যেকে আধা গ্লাস করে পানি অপচয় করি, তাহলে ৮ কোটি গ্লাস পানি অপচয় হবে। আমাদের এই অপচয় বন্ধ করা দরকার। আমি নিজে এটা করলে নিশ্চয়ই অন্যদেরও বলতে পারব।’

অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম, আমাদের পরিবেশসংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জেনে ওই মেয়েটি শুধু বসে থাকেনি, অন্তরে ধারণ করেছে, চর্চা করছে, এমনকি অন্যকেও জানানোর চেষ্টা করছে। সেদিন আমার মনে হয়েছে এই মেয়েটি বাংলাদেশের একটি অনগ্রসর অঞ্চলের শিক্ষার্থী হয়েও মেধা ও মননে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের উপায় চর্চা করার সক্ষমতা রাখে। আমাদের জন্য এমন সুসংবাদ এ দেশে নারীর ক্ষমতায়নের পথকে সুগম করবে বলে বিশ্বাস করি।

নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শিক্ষার চাহিদা তৈরি হয়ে গেছে। আমাদের এই বিশাল অর্জনটি প্রায়ই দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়। প্রতিবেশী বিশাল দেশ ভারতেও অনেক পশ্চাৎপদ রাজ্য আছে, যেখানে একজন দরিদ্র কৃষক হয়তো সোজা বলে দেবেন, ‘লেখাপড়া শিখিয়ে কী লাভ?’ আমাদের দেশে কিন্তু এই কথাটি এখন আর শোনা যায় না। দারিদ্র্যের সঙ্গে, পরিবেশ বিপর্যয়ের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রামে রত এ দেশের অগণিত সহিষ্ণু মানুষ আজ শিক্ষার সঙ্গে মানব সক্ষমতা বিনির্মাণের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে অনুধাবন করে, অন্তরে ধারণ করে। কিন্তু সুযোগটা হয়তো অনেক সময় তারা সেভাবে পায় না। তবে মেয়েশিশুকে লেখাপড়া করানোর ইচ্ছার ব্যাপারে তাদের মধ্যে তেমন সংশয় নেই।

সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণায়ও উঠে এসেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ছেলেসন্তানের প্রতি মা-বাবার যে ঝোঁক থাকে, তা বাংলাদেশে অনেক কমে এসেছে। মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য মা-বাবার আকাঙ্ক্ষাই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে আমরা ছেলে ও মেয়ের সমতা অর্জন করেছি। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এ এক বড় অর্জন। পৃথিবীর বহু উন্নয়নশীল অথবা অনুন্নত দেশ এটি পারেনি। আমরা ২০০৫ সালে এই সাফল্য অর্জন করেছি এবং এটি ধরেও রাখতে পেরেছি।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, শিক্ষার সর্বস্তরে নারী শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ ক্রমাগত বাড়ছে। এটি একদিকে আমাদের জন্য অনেক বড় অর্জন, আবার অন্যদিকে একটি বড় চ্যালেঞ্জও বটে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি থাকলেও সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ওপরের দিকে ক্রমেই নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমতে থাকে। এই বিষয়টি এখন আর অগ্রাহ্য করার কোনো অবকাশ নেই। তবে আশার কথা এই যে সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা সত্ত্বেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।

তবে আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা এখনো অপ্রতুল। মেডিকেল কলেজগুলোতে মেয়েদের জন্য পর্যাপ্ত হল না থাকায় তাদের আবাসনের সমস্যা থেকেই যায়। তাদের যাতায়াত, নিরাপত্তা এই সমস্যাগুলো সরকারের পক্ষে একা নিরসন করা সম্ভব নয়। এর জন্য আমাদের সামাজিক উদ্যোগেরও প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাইরেও যেন মেয়েরা নিরাপদে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে পারে, সে ব্যবস্থা করে দেওয়া দরকার।

বাংলাদেশে এখন বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে মনে করা হচ্ছে, মেয়েরা যদি উপার্জনক্ষম হয় তাহলে পরিবারের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। এ ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার ভূমিকাই প্রধান। গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অধিকাংশই নারী। লেখাপড়া শিখেছেন বলেই তাঁরা ব্যবসার উদ্যোগ গ্রহণের সাহস করতে পারছেন। মূলধনের জন্য ব্যাংকের সঙ্গে এমনকি নীতিনির্ধারকদের সঙ্গেও দেন-দরবার করতে পারছেন।

সূত্র: ব্যানবেইস
সূত্র: ব্যানবেইস

আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, যে মা অন্তত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন, সেই মায়ের সন্তান কখনো নিরক্ষর হয় না, অপুষ্টিতে ভোগে না। গত দুই দশকে শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ইতিবাচক ফলাফল আমরা এখন পাচ্ছি। ১০ বছর আগে যে মেয়েরা মাধ্যমিক শিক্ষায় অংশ নিয়েছিল তাদের অনেকেই এখন মা হয়েছেন। তাঁদের সন্তানদের তাঁরা নির্দ্বিধায় বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন বলেই আজকে বাংলাদেশের এই অর্জন দৃশ্যমান।
প্রধানত তিনটি কারণে আমরা নারী শিক্ষায় আজকের এই অবস্থানে আসতে পেরেছি। আমাদের শিক্ষাবান্ধব রাষ্ট্রীয় নীতিমালা নারী শিক্ষার প্রসারে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে। আমরা দেখেছি, সরকার পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু নারী শিক্ষার্থীর জন্য ইতিবাচক নীতিমালার পরিবর্তন হয়নি। দ্বিতীয় কারণটি হলো, নারী শিক্ষার প্রতি আপামর জনগোষ্ঠীর ইতিবাচক মনোভাব। আর তৃতীয় কারণটি হলো আমাদের বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) সচেতনতামূলক ব্যাপক কর্মকাণ্ড। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এনজিওগুলো উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারও এগিয়ে এসেছে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিবন্ধিত সরকারি বিদ্যালয় থেকে পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেয়েশিশুর উন্নয়নে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
আমাদের এ অগ্রযাত্রায় ভারতীয় নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, এ দেশের সংগ্রামী মানুষের অমিত সদিচ্ছাকে অভিবাদন জানিয়েছেন। সামনের দিনগুলোতেও আমাদের এই সাহসী অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে।
মেয়েশিশুর শিক্ষার জন্য সরকারের উপবৃত্তি কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এই উপবৃত্তির পরিমাণ ২০০৪ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত খুবই সামান্য পরিমাণে বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সংগতি রেখে এটি চাহিদা অনুযায়ী বাড়াতে হবে।
এ দেশের প্রত্যন্ত, দারিদ্র্যপীড়িত ও খাদ্যাভাবগ্রস্ত এলাকাগুলোর বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য ‘দুপুরের গরম খাবার’ কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে। এতে করে এ অঞ্চলগুলোতে সামগ্রিক শিক্ষা পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

বেসরকারি উদ্যোগেও অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথম আলো প্রতিবছর ‘অদম্য মেধাবী’ শিরোনামে দেশের সুবিধাবঞ্চিত মেধাবীদের সংগ্রামী কাহিনি তুলে ধরে। আমাদের উচিত হবে, যেই মেয়েটি বা যেই ছেলেটির কথা প্রথম আলো আমাদের সামনে তুলে ধরল, শিক্ষার জন্য সামনের পথটুকু চলতে যেন তাকে আর সংগ্রাম করতে না হয়, সেই ব্যবস্থা করে দেওয়া। কিছু কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এই দায়িত্ব পালনে উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এগুলো এখনো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

নারীর প্রতি সহিংসতা আমাদের দেশের নারীদের উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে বড় একটি বাধা। ‘ইভ টিজিং’ নামক একটি ব্যাধি আমাদের সমাজে মাঝেমধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যম ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সাহসী ও দৃঢ় পদক্ষেপের ফলে এটিকে আমরা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি। সমাজে মেয়েদের প্রতি সহিংসতা রোধ করতে হলে সামাজিক সচেতনতা ও সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে অনেক সাহসী পদক্ষেপের ঘটনাগুলোকে গণমাধ্যম সমাজে ছড়িয়ে দিয়ে সচেতনতা বাড়াতে পারে।

আমাদের দেশের নারীদের প্রতি সহিংসতার আরেকটি মাধ্যম এখন দেখা যাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে নারীর মর্যাদাকে হেয় করা হচ্ছে। এটি রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান ও তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের আরও সচেতন, কঠোর ও উদ্যোগী হতে হবে। এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদেরও ভূমিকা রয়েছে।

বাল্যবিবাহকে এক অর্থে নারীর প্রতি সহিংসতা বলা চলে। একটি মেয়েকে যখন অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় তখন একটি সম্ভাবনাময় ফুলের কুঁড়িকেই ছিঁড়ে ফেলা হয়। দেশের অনেক এলাকায় বাল্যবিবাহ রোধের অনেক সাহসী গল্প রয়েছে, এই গল্পগুলোকে আপামর জনগোষ্ঠীর সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন।

আমাদের দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে যাঁরা সফল নারী রয়েছেন, তাঁরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে গিয়ে উদ্বুদ্ধকরণের কাজ করতে এগিয়ে আসতে পারেন। এতে নারী শিক্ষায় মানুষ আরও আগ্রহী হয়ে উঠবে। সাধারণ মানুষকে এটি বোঝানো প্রয়োজন যে নারী শিক্ষা শুধু অর্থ উপার্জনের প্রয়োজনে নয়, শুধু নারী উন্নয়নের জন্যই জরুরি নয়, সমাজের ও দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নারী শিক্ষা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ অদম্য সাহসের সঙ্গে একটি যুদ্ধ জয় করে স্বাধীন হয়েছে, এই যুদ্ধে নারী-পুরুষনির্বিশেষে লড়াই করেছে। স্বাধীন মাতৃভূমি আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছোট-বড় অনেক সাফল্য অর্জন করেছি। এর প্রতিটি অর্জনই একেকটি সাহসিকতার গল্প। এই সাহসী পদক্ষেপ অব্যাহত রেখে আমরা যে জায়গায় যেতে চাই সেটি আত্মতুষ্টির নয়, আত্মবিশ্বাসের জায়গা। সেই আত্মবিশ্বাসের অবস্থান থেকে আরও অনেক সাহসী উদ্যোগ বেরিয়ে আসবে, অনেক কূপমণ্ডূকতা দূর হয়ে যাবে, আরও অনেক সাফল্য অর্জিত হবে—এটাই আগামীর জন্য প্রত্যাশা।

রাশেদা কে চৌধূরী: নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান