সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হলো সাংবাদিকতার

মিজানুর রহমান খান

মিজানুর রহমান খান, আমাদের মিজান ভাই সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করতেন, কিন্তু সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ ছিল বার্তা বিভাগের সঙ্গে। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন সংবাদকর্মী। কেবল সম্পাদকীয় বা কলাম লেখার মধ্যেই নিজেকে আটকে রাখেননি তিনি; রিপোর্টিংয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। প্রথম পাতার জন্য রিপোর্ট লিখতেন, বিশ্লেষণ ছাপা হতো। আর আমরা তো সব সময়ই বলতাম, আমাদের সেরা সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাংবাদিক মিজান ভাই।

এই যে বললাম মিজান ভাইয়ের সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ ছিল বার্তা বিভাগের সঙ্গে, এ কথার প্রতিবাদ হয়তো করবে প্রথম আলোর ভিডিও বিভাগ। নিজেই দেখেছি, তাঁর হাতের মোবাইল ফোনটি ছিল আসলে একজন এ যুগের সাংবাদিকের ফোন। তিনি ছবি তুলতেন, ভিডিও করতেন। কেবল সাক্ষাৎকারের ভিডিও নয়, তিনি ভিডিও রিপোর্টিংও করতেন। সেই ভিডিও সম্পাদনার জন্য তিনি দিনের পর দিন পড়ে থাকতেন ১১ তলার ভিডিও বিভাগে।

২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সময় আমরা উৎসাহ দেওয়ার জন্য মোজো প্রতিযোগিতার আহ্বান করেছিলাম। দেখা গেল বিপুল উৎসাহে নাম লেখালেন মিজান ভাই। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর জন্য ছোট ছোট কয়েকটি কৌতুক গল্পের শুটিং করেছিলাম। মহোৎসাহে সেখানে অভিনয় করলেন মিজান ভাই।
এই মিজান ভাই একবার প্রথম আলোর সেরা আলোকচিত্রীর পুরস্কার পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

আমি তখন বার্তা বিভাগের দায়িত্বে। পুরোনো পত্রিকা বের করে দেখলাম তারিখটি ছিল ৩ এপ্রিল, ২০১৮। ওই দিন দুপুরের কিছু পরে মিজান ভাই সরাসরি বার্তা বিভাগে এসে বললেন, তিনি একটি ছবি তুলেছেন, ছাপব কি না, জানতে চাইলেন। সোনারগাঁও মোড় ধরে হেঁটে আসার সময় তিনি ছবিটি তুলেছিলেন, দুই বাসের পাল্লাপাল্লিতে বাসের চাপায় আটকে আছে একটি হাত, রাজীবের হাত।

কলেজছাত্র রাজীবের বাস দুর্ঘটনার রিপোর্ট সবাই করেছিলেন। কিন্তু মিজান ভাইয়ের তোলা সেই ছবি না হলে কজনই–বা আজও মনে রাখতেন সেই রাজীবকে। কিংবা ঘটনাটি নিয়ে এত তোলপাড়ও হতো না। বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার প্রতীকী ছবি হয়ে আছে মিজান ভাইয়ের তোলা সেই ছবি।

এই তো সেদিনকার ঘটনা। গ্রাহকদের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার। বিস্ময়কর ঘটনা ছিল হয়রানিমুক্ত জীবন চেয়ে তাঁর পক্ষে আদালতে আবেদন। পি কে হালদার দেশে ফিরতে চান, কিন্তু তাঁকে হয়রানি করা যাবে না। একজন পলাতক আসামির এভাবে আদালতে আবেদনের ঘটনা নজিরবিহীন। মিজান ভাই প্রথম আলোর প্রথম পাতায় লিখলেন, ‘অবশেষে পি কের আদালত অবমাননা’। ছাপা হলো ২৬ অক্টোবর। মিজান ভাই নেই, এ ধরনের বিস্ময়কর ঘটনা নিয়ে এখন কে লিখবেন আর? কে মনে করিয়ে দেবেন আইনের নানা অসংগতির কথা।

ফেসবুক মেসেঞ্জারে লেখককে পাঠানো মিজানুর রহমান খানের বার্তা।

মিজান ভাইয়ের চলে যাওয়া আমাদের অনেকের জন্য ব্যক্তিগত ক্ষতি, সাংবাদিকতার ক্ষতি আরও অনেক অনেক বেশি। সম্পাদক মতি ভাই বলেন, সাংবাদিকতা করতে গেল একধরনের পাগলামি লাগে। সম্ভবত মিজান ভাইয়ের মধ্যে তা পুরোমাত্রায় ছিল।

আমি ছিলাম প্রথম আলোর করোনায় আক্রান্ত প্রথম কর্মী। মুগদা জেনারেল হাসপাতালে আমি ভর্তি হয়েছিলাম ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল। তীব্র আতঙ্কের সময় ছিল সেটি। চিকিৎসাব্যবস্থা জানা ছিল না, কাছে আসতেন না কেউই। সে সময় প্রথম আলোই ছিল ভরসার সবচেয়ে বড় জায়গা। সম্পাদকের নির্দেশে প্রথম আলোর প্রশাসন বিভাগ ছায়ার মতো লেগে ছিল। এরপর প্রথম আলোর ৮১ জন কর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। সবাই সুস্থ হয়েছেন। হেরে গেলাম কেবল মিজান ভাইয়ের কাছে।
মুগদা হাসপাতালে আমি ভর্তি হয়েছিলাম দুপুর ১২টার কিছু পরে। ওই দিন ঠিক ৩টা ৩৯ মিনিটে ফেসবুক মেসেঞ্জারে মিজান ভাইয়ের বার্তা এসেছিল। তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রিয় মাসুম ভাই, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি আপনি দ্রুত সেরে উঠবেন।’
আমরা সবাই সেরে উঠেছি, কিন্তু আপনি আমাদের থেকে দূরে সরে গেলেন, মিজান ভাই।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন