সবার আনন্দে বিদ্যানন্দ

সব সময়ই শিশুদের জন্য আহারের ব্যবস্থা করে আসছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনছবি: সংগৃহীত

করোনাকাল আমাদের জীবনযাপন ও জীবনমান বদলে দিয়েছে। কিন্তু বদলে দিতে পারেনি বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের কাজ। বরং এই দুঃসময়ে বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের গতি বেড়েছে।

বিদ্যানন্দ নানা স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ নিয়ে সমাজের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই মার্চ মাসে, করোনার শুরুতেই। তখন ঢাকার মিরপুরে প্রথম উত্তর টোলারবাগ, পরে পুরো টোলারবাগ এলাকা লকডাউন ঘোষণা করা হয়। কয়েক দিন পর লকডাউন হতে শুরু করে বিভিন্ন এলাকা। তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, লকডাউনে থাকা বাড়িগুলোতে খাবার পৌঁছে দেবেন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা।

এপ্রিল মাসের দিকে দেশের উত্তর–পূর্বাঞ্চলে দেখা দেয় বন্যা। নিদারুণ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে লাখ লাখ মানুষ। দেখা দেয় পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া। এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যানন্দ এসএমসি লিমিটেডের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এসব দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের মধ্যে বিনা মূল্যে খাওয়ার স্যালাইন, কোমল পানীয়ের পাউডার ও বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি বিতরণ শুরু করে।

ফিরোজ চৌধুরী

এমন বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেই পবিত্র রমজান মাস চলে আসে। রমজানজুড়ে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন বিভিন্ন এলাকায় দুস্থ পরিবারগুলোকে ইফতার ও সাহ্​রির খাবার পৌঁছে দিয়েছে। ঈদের আগমুহূর্তে বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবীরা ছুটে গেছেন জামালপুর ও সুনামগঞ্জের বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে। কাজ করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত এলাকায়। সেখানে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বৈদ্যুতিক ভ্যান, সেলাই মেশিন ও ছাগল বিতরণ করা হয়েছে।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুড়িগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, কক্সবাজার ও খাগড়াছড়ির ৩১ হাজারের বেশি মানুষের মধ্যে ঈদের বিশেষ খাবার দিয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের জামালপুর ব্যাটালিয়নের (৩৫ বিজিবি) তত্ত্বাবধানে তিন হাজার পরিবারকে ৪ কেজি চাল, ৪ কেজি আটা ও ২ কেজি করে ডাল দিয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। বিজিবির সঙ্গে বিদ্যানন্দ আরও কাজ করেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত এলাকায়। সেখানে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বৈদ্যুতিক ভ্যান, সেলাই মেশিন ও ছাগল বিতরণ করেছে।

ফেনীতে ‘এক টাকায় আহার’ প্রকল্পের আওতায় দুই হাজার সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করেছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। এই এক টাকায় আহার কার্যক্রমের মাধ্যমেই ২০১৬ সালে আলোচনায় আসে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। যদিও বিদ্যানন্দের যাত্রা শুরু আরও আগে, সেই ২০১৩ সালে। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে ‘পড়বো, খেলবো, শিখবো’ স্লোগান নিয়ে নারায়ণগঞ্জে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়ালেখার সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের গোড়াপত্তন করেন কিশোর কুমার দাশ নামের এক স্বপ্নবান তরুণ। ক্রমে বিদ্যানন্দের ছায়াতলে যুক্ত হতে থাকেন অনেক তরুণ স্বেচ্ছাসেবী। বর্তমানে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, রাজশাহী, কক্সবাজারসহ মোট ১৩টি শাখা রয়েছে বিদ্যানন্দের। এ ছাড়া তাদের পাঁচটি স্কুলে একাডেমিক শিক্ষা পাচ্ছে এক হাজারের বেশি শিশু। তাদের ছয়টি অনাথ আশ্রমে রয়েছে ৪৫০ জনের বেশি শিশু। সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় ২৫টির বেশি জায়গায় প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার শিশুর খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এক টাকায় স্যানিটারি প্যাড, এক টাকায় চিকিৎসাসহ নানা রকম কর্মসূচির সুবিধা পাচ্ছে শত শত নারী ও শিশু।

করোনাকালে সবার আনন্দের জন্য সত্যিই যেন কান্ডারির ভূমিকায় নেমে পড়ে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। এই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা নিজেকে উজাড় করে দিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বাংলাদেশে করোনা হানা দেওয়ার শুরুতেই ঢাকা ও চট্টগ্রামের যেসব স্থানে জনসমাগম বেশি, সেসব স্থানে জীবাণুনাশক ছিটানো এবং মাস্ক-অ্যাপ্রোন ইত্যাদি তৈরি ও বিতরণের কাজ শুরু করে বিদ্যানন্দ। এরপর চিকিৎসা সেবাদানকারীদের জন্যও এগিয়ে আসে প্রতিষ্ঠানটি। তারা একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে চিকিৎসকদের জন্য প্রায় আড়াই হাজার গাউন তৈরি করে বিতরণ করেছে। যখন চিকিৎসক, নার্সদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের সংকট ছিল, তখন বিদ্যানন্দ নিজেদের বাসন্তী গার্মেন্টসে পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) বানিয়েছে। সেই পিপিইগুলো বিনা মূল্যে সরবরাহ করেছে ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে।

করোনাকালে সবার আনন্দের জন্য সত্যিই যেন কান্ডারির ভূমিকায় নেমে পড়ে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। এই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা নিজেকে উজাড় করে দিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

এর মধ্যে দোকানে দোকানে সংকট দেখা দেয় হ্যান্ড স্যানিটাইজারের। বিদ্যানন্দ কি বসে থাকবে? মোটেও নয়। তারা নিজেরাই উদ্যোগ নেয় অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার তৈরি করে বিনা মূল্যে বিতরণের। এ কাজ করতে গিয়েও তাদের অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। সাধারণ দামের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি দামে কিনতে হয়েছে কাঁচামাল। তবু তারা পিছু হটেনি। বিনা মূল্যেই বিতরণ করেছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার।

করোনার কান্ডারিদের গল্প এখানেই শেষ নয়। সারা দেশে সবজির দাম যখন লাগামছাড়া, তখন বিদ্যানন্দ দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে ট্রাকে করে সবজি এনে রাস্তার পাশের দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বিতরণ করেছে। এতে উপকৃত হয়েছেন কৃষকেরাও। লকডাউনের কারণে বাজারে গিয়ে ফসল বিক্রি করতে পারছিলেন না তাঁরা। বিদ্যানন্দ সরাসরি তাঁদের কাছ থেকে সবজি কিনেছে। এ ছাড়া বিদ্যানন্দ খাবার পৌঁছে দিয়েছে শহরের কিছু কিছু বৃদ্ধাশ্রম এবং অনাথ আশ্রমেও।

শুধু অসহায় মানুষ নয়, বোবা প্রাণীদের কান্নাও বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবীদের ব্যথিত করে। তাই করোনার এই দুঃসময়ে প্রতিদিনকার কাজের ফাঁকে রাস্তার প্রাণীগুলোর জন্যও খাবারের ব্যবস্থা করেছে এই সংগঠনের তরুণ দল। বোবা প্রাণী আর অসহায় ছিন্নমূল মানুষগুলো ঘুমায় যে রাস্তায় ও ফুটপাতে, সেসব জায়গাও জীবাণুনাশক দিয়ে ধুয়ে দিয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। তারা একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অনুদানে তিন লাখ লিটার জীবাণুনাশক দিয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বাসস্টপেজ, রেলস্টেশনের মতো জায়গাগুলো, যেখানে জনসমাগম বেশি হয়, ভাইরাস সংক্রমণ ঘটাতে পারে, সেসব জায়গা ও শহরের রাস্তা ধুয়ে দিয়েছে।

মানুষের হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করে দিতে রাজধানীর মিরপুর, ফার্মগেট, গুলশান, শাহবাগসহ বিভিন্ন স্থানে বসিয়েছে অস্থায়ী হাত ধোয়ার বেসিন। সরবরাহ করা হয়েছে পানি ও সাবান। তৈরি করেছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক; যা বিতরণ করা হয়েছে খেটে খাওয়া মানুষদের মধ্যে।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন বিভিন্ন মাধ্যম থেকে অনুদান সংগ্রহ করছে। আর সেসব অনুদানের অর্থে প্রায় পাঁচ লাখ খেটে খাওয়া মানুষ পাচ্ছেন এক বেলা খাবার, সুবিধাবঞ্চিত হাজার হাজার শিশু পাচ্ছে লেখাপড়ার সুযোগ।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের এসব মহৎ উদ্যোগকে সফল করতে এগিয়ে এসেছে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে শুধু সরকারের ওপর নির্ভর করে বসে না থেকে অনেক ভালো কাজ যে নিজেরাই করা যায়, তা বুঝিয়ে দিয়েছে বিদ্যানন্দের এসব নিঃস্বার্থ উদ্যোগ। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন দেখিয়ে দিয়েছে, দুঃসময়ে কাউকে না কাউকে হাল ধরতে হয়।


ফিরোজ চৌধুরীপ্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক