দুটি বাংলাদেশি কৃষিপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘের ‘সবার জন্য ভালো খাবার (গুড ফুড ফর অল)’ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছে। জাতিসংঘের ফুড সিস্টেম শীর্ষ বৈঠকের প্রাক্কালে গত ২৭ জুলাই এই প্রতিযোগিতার ফলাফলে ৪২টি দেশের ৫০টি প্রতিষ্ঠানকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এগুলোর মধ্যে ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া থেকে ১০টি, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে ১৩টি, পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে ১০টি, দক্ষিণ এশিয়া থেকে ৮টি এবং উত্তর ও লাতিন আমেরিকা থেকে ৯টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
বিজয়ী উদ্যোক্তাদের অর্ধেক তরুণ ও নারী। মোট ১৩৫টি দেশের ২ হাজার প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে এই ৫০টি প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করা হয়েছে। স্বীকৃতি ছাড়াও বিজয়ী প্রতিষ্ঠানগুলো ১ লাখ ডলারের নগদ পুরস্কার ভাগাভাগি করে নেবেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের ফুড সামিটের বিশেষ দূত বিজয়ীদের নাম ঘোষণার সময় বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই তাদের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্ক জানা দরকার। কারণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা হলো আমাদের খাদ্যব্যবস্থার নীরব নায়ক। শত প্রতিকূলতার মধ্যে তারা তাদের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।’
কমিউনিটির জন্য স্বাস্থ্যকর, অধিকতর লাগসই এবং ন্যায্য খাবার ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উদ্যোগসমূহের অবদান, আগামী দিনে তাদের সক্ষমতা এবং নিজেদের উদ্যোগের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রভাব যথাযথভাবে প্রকাশ করছে পারছে কি না তার ওপর ভিত্তি করে বিজয়ীদের নির্বাচিত করা হয়েছে।
বিজয়ী এদেশীয় দুটি প্রতিষ্ঠান হলো ‘আমাদের খামার বাংলাদেশ’ ও ‘আইপেজ বাংলাদেশ লিমিটেড’।
বিজয়ী ‘আমাদের খামার বাংলাদেশ’ কাজ করছে নিরাপদ খাবারের ভ্যালু চেইন ও সাপ্লাই চেইন নিয়ে। এর উদ্যোক্তা ইকবাল হোসেন জানালেন, তাঁরা ক্ষুদ্র কৃষি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কাজ করেন। কৃষি উদ্যোক্তাকে ভালো মানের বীজ সরবরাহ ও খামারের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য সহায়তা করেন। তারপর উৎপাদিত ফসল তাদের সাপ্লাই চেইনের মাধ্যমে বাজারে পৌঁছে দেন। ইকবাল হোসেনের মতে, ক্ষুদ্র কৃষি উদ্যোক্তারা আলাদাভাবে কাজ করেন বিধায় সাশ্রয়ী মূল্যে বাজারে নিরাপদ খাবার পৌঁছাতে পারেন না। ভবিষ্যতে অ্যাপের মাধ্যমে সারা দেশের ক্ষুদ্র কৃষি উদ্যোক্তাদের তাঁর প্ল্যাটফর্মে আনার জন্য পরিকল্পনা করছেন। এতে ভোক্তার জন্য সাশ্রয়ী মূল্য নিশ্চিত হবে অন্যদিকে উদ্যোক্তারা ন্যায্যমূল্য পাবেন বলে তিনি মনে করেন।
পুরস্কারপ্রাপ্তির চেয়েও দেশকে বহির্বিশ্বে তুলে ধরতে পেরে ইকবাল হোসেন খুশি। তিনি আশা করছেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং সরকারি সহায়তা পেলে ‘আমাদের খামার’কে তিনি আরও বড় করতে পারবেন।
দেশীয় কৃষিপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইপেজ বাংলাদেশ লিমিটেড মেশিন লার্নিং, প্রিসিশন হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কৃষিক্ষেত্রে সমন্বিত তথ্যসেবা দিয়ে থাকে। দেশের প্রায় ৬৭ লাখ ক্ষুদ্র কৃষককে বাজার চাহিদা মোতাবেক ফসল উৎপাদন কৌশল নির্ধারণ ও সেসব ফসল নিরাপদে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক কৃষিতথ্য, চাষপদ্ধতি ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে আইপেজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে একটি সমন্বিত কৃষি সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কাজ করছে। একদল তরুণ প্রযুক্তি উদ্যোক্তার প্রচেষ্টায় নির্মাণাধীন এই কৃত্রিম কৃষি বুদ্ধিমত্তা বা অ্যাগ্রিকালচারালের নাম দেওয়া হয়েছে ইকুইলিব্রিয়াম, যার মাধ্যমে কৃষকেরা পাচ্ছেন প্রয়োগযোগ্য তথ্যের জোগান এবং যুক্ত হতে পারছে স্থানীয় বাজারের সঙ্গে। এতে করে মধ্যবর্তী ফড়িয়াদের কবল থেকে তারা মুক্ত থাকতে পারবে।
ওই প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষকেরা যে শুধু উৎপাদন এবং বিপণন-সংক্রান্ত তথ্যসুবিধাই পাবেন তা নয়, স্থানীয় নিবন্ধনকৃত সার, কীটনাশক ও বীজ ডিলারদের মূল্যতালিকাসহ তথ্য এবং কৃষি মূলধনপ্রাপ্তির সম্ভাব্য উৎসসমূহের তথ্যও মিলবে এই তথ্যপ্রযুক্তি সেবার মাধ্যমে।
বর্তমানে টাঙ্গাইল, গাইবান্ধা ও পাবনায় পাইলট কার্যক্রমের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে ১২৮৫ জন কৃষকের সম্পৃক্ততায়, ভিন্ন ধরনের মাটি ও ফসল চক্রে ওই প্রযুক্তিটির প্রায়োগিকতা এবং জাতীয় পর্যায়ে প্রসারের বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রকৌশলী মাশরূর এইচ সুহৃদ বলেন, ‘আমাদের কৃষিতথ্য সেবাটি মূলত মাঠপর্যায়ে ইলেকট্রনিক সয়েল টেস্টিং থেকে শুরু করে মৌসুমের বিভিন্ন সময়ে রোগবালাই, পোকামাকড় শনাক্তকরণ এবং প্রয়োজনীয় কৃষি ব্যবস্থাপনা পত্র প্রদানে সক্ষম। কিন্তু এ ধরনের সাইট এবং ক্রপ স্পেসিফিক, প্রিসিশন টেকনোলজি বেইজড সেবা গ্রহণে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় এনজিওরা বেশ সহযোগিতা করছে। পাশাপাশি সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ এবং সম্প্রসারণ বিভাগেরও সহায়তা পাচ্ছি।’
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মাদ সাইফুল্লাহ মিঠু বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্রমবর্ধনশীল জনসংখ্যা এবং ক্রমহ্রাসমান আবাদযোগ্য জমির প্রেক্ষাপটে এ ধরনের প্রযুক্তির প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, সরকার তো অবশ্যই, সেই সঙ্গে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা যাঁরা কৃষকদের মাঝে ক্ষুদ্রঋণ কিংবা বাজারজাতকরণ নিয়ে কাজ করছেন, তাঁরাও আমাদের এই উদ্যোগে অংশীদার হতে পারেন।’
আইপেজের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এর প্রধান নির্বাহী মাশরূর হোসেইন জানান, ‘আগামী ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যম মেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক কৃষিসংক্রান্ত তথ্যের স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু পরিবেশক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাই আমরা। দেশটা আমাদের, এই মাটি আমাদের, এই কৃষক আমাদের। অতএব দেশীয় মেধা, প্রযুক্তি এবং গবেষণালব্ধ ফলাফলকে এই দেশের কৃষিক্ষেত্রে প্রায়োগিকতা দেওয়ার দায়িত্বও আমাদেরই।’
আইপেজের ব্যবহৃত প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও বিকাশ দেশীয় প্রযুক্তিবিদ এবং একদল কৃষি শিক্ষাবিদের যৌথ প্রয়াসে সম্ভব হয়েছে। ওই প্রযুক্তিসেবা ব্যবহার করে মাটির গুণাগুণ ও বাজারের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনের ক্ষেত্রে সার, বীজ, কীটনাশক ও প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রিত প্রয়োগে প্রান্তিক কৃষকদের অভ্যস্ততা বাড়ছে, যা পরিবেশ এবং জলবায়ু সংরক্ষণে দীর্ঘমেয়াদি অবদান রাখতে সক্ষম। প্রতিষ্ঠানটি এর আগে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম, গেইন, এসবিএনের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘আরবান ফুড চ্যালেঞ্জে’ বিজয়ী হয়েছিল।