সম্ভাবনার 'ডিজিটাল' মৌ-বাক্স

ডিজিটাল মৌ–বাক্স
ডিজিটাল মৌ–বাক্স

লিচু চাষে প্রসিদ্ধ দিনাজপুর। লিচুর মৌসুমে মুকুল থেকে মধু সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই জেলায় ছুটে আসেন মৌচাষিরা। প্রতিবছরের মতো লিচুগাছের নিচে এবারও তাঁরা বসিয়েছেন মৌ-বাক্স। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয় বলছে, লিচুবাগানে মৌ চাষের ফলে একদিকে মৌ‍চাষিরা যেমন মধু সংগ্রহ করতে পারছেন, অপর দিকে মৌমাছি লিচুর ফুলে পরাগায়ন ঘটানোর ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে লিচুর ফলন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দিনাজপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. তৌহিদুল ইকবাল জানান, এই জেলায় এবার ৫ হাজার ২৮১ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হচ্ছে। বাগানগুলোতে রয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৩টি লিচুর গাছ। এসব লিচুর বাগান থেকে গত মৌসুমে ১০০ মেট্রিক টন মধু সংগ্রহ করেছেন মৌচাষিরা। চলতি মৌসুমেও ১০০ মেট্রিক টন মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৪৭ মেট্রিক টন মধু সংগ্রহ করা হয়েছে। এই মৌসুমে দিনাজপুরে ৩ শতাধিক চাষি ১০ হাজারের বেশি মৌ–বাক্স নিয়ে মৌ চাষ করছেন। তবে এবার লিচুতে মুকুল কম ধরায় মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

সপ্তাহজুড়ে দিনাজপুরের বিরল, চিরিরবন্দর ও সদর উপজেলার লিচুবাগান ঘুরে দেখা গেছে, বাগানে লিচুগাছ ঘিরে চারপাশে বসানো হয়েছে মৌ-বাক্স। বাক্স ঘিরে মৌমাছির ভোঁ-ভোঁ শব্দ। বাগানের এক পাশে তাঁবু গেড়ে অস্থায়ীভাবে বাস করছেন মৌ‍চাষিরা। এসব মৌচাষির অধিকাংশই সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, সাতক্ষীরা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছেন। তবে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বাইরে থেকে আসা মৌচাষিদের মধু সংগ্রহ দেখে মৌ চাষে আগ্রহ বেড়েছে স্থানীয় লোকজনের মধ্যেও।

বিরল উপজেলার মাধববাটি এলাকায় মধু সংগ্রহে এসেছেন আবদুর রশিদ (৫৫)। তিনি সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা উপজেলার হাটিকুমরুল থেকে এসেছেন। রশিদ জানালেন, তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে মৌ চাষের সঙ্গে যুক্ত। প্রায় ২২ বছর ধরে প্রতিবছর লিচু মৌসুমে তিনি আসেন মধু সংগ্রহের জন্য। তাঁর হাত ধরে তিন শতাধিক লোক এই পেশায় যুক্ত হয়েছেন বলে জানান তিনি।

বিরল উপজেলার মাধববাটি এলাকায় নুরুল ইসলামের বাগানে তাঁবু গেড়েছেন আবদুর রশিদ। বাগানে বসিয়েছেন ২৫০টি মৌ-বাক্স। তার মধ্যে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন থেকে পাওয়া ‘ডিজিটাল’ মৌ-বাক্স রয়েছে ১৫০টি। রশিদ জানান, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন থেকে মৌ চাষের ওপর প্রশিক্ষণ শেষে এবারই প্রথম ডিজিটাল এই মৌ–বাক্সগুলো তাঁকে দেওয়া হয়েছে। তুরস্ক থেকে আনা এই ডিজিটাল মৌ-বাক্সগুলো কাঠের বাক্সের তুলনায় আকারে কিছুটা বড়। এর ভেতর পানি ঢোকার আশঙ্কাও নেই। কাঠের বাক্সগুলোর ফ্রেমে লোহার তার ব্যবহার করা হয়। এতে মরিচা ধরে এবং রোগজীবাণুর সৃষ্টি হয়। অপর দিকে ডিজিটাল বাক্সে মৌচাকের ফ্রেমটি ফুড গ্রেড প্লাস্টিকের তৈরি হওয়ায় এটি স্বাস্থ্যসম্মত। কাঠের বাক্সে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার উপায় না থাকায় অনেক সময় মৌমাছি মরে যায়। অপর দিকে ডিজিটাল এই মৌ–বাক্স তাপমাত্রা–নিয়ন্ত্রিত। সর্বোপরি কাঠের বাক্স থেকে আধুনিক এই মৌ–বাক্সে দ্বিগুণ মধু পাওয়া যায় বলে জানালেন আবদুর রশিদ।

মধু সংগ্রহের পাশাপাশি এবারই প্রথম আধুনিক এই মৌ-বাক্স থেকে পোলেন সংগ্রহ করছেন আবদুর রশিদ। তিনি জানান, ফুলের পরাগ থেকে নির্যাস সংগ্রহের সময় মৌমাছি তার পায়ে সংগ্রহ করে নিয়ে আসে এই পোলেন। এই পোলেন মূলত বাচ্চা মৌমাছির খাবার। এই পোলেন জমা হয় বাক্সের পোলেন ট্রেতে। প্রতিবছর একটি বাক্স থেকে এক কেজি পর্যন্ত পোলেন সংগ্রহ করা যায়।

কাঠের মৌ–বাক্স
কাঠের মৌ–বাক্স

এ প্রসঙ্গে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় মৌ চাষ নিয়ে, বিশেষত মৌ–বাক্স থেকে পোলেন সংগ্রহ নিয়ে গবেষণা চলছে। এই পোলেনের মধ্যে থাকে ভিটামিন বি। উন্নত দেশে এটি পাখির খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া ক্রান্তিকালে মৌমাছির খাবার হিসেবেও ব্যবহৃত হয় পোলেন দানা। একজন মানুষ দৈনিক পাঁচ-সাতটি পোলেন দানা খেলে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। বাংলাদেশ প্রতিবছর ওষুধ তৈরির জন্য এই পোলেন বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। প্রতি কেজি পোলেনের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য ৮ থেকে ১০ ডলার। বাংলাদেশে তাপনিয়ন্ত্রিত আধুনিক মৌ–বাক্সে ব্যাপকভাবে মৌ চাষ শুরু হলে তাতে একদিকে যেমন মধুর উৎপাদন বাড়বে, অন্যদিকে দেশে পোলেনের চাহিদা মিটিয়ে তা রপ্তানি করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, উন্নত প্রযুক্তিতে মৌ চাষ করলে দেশে বর্তমানে ২৫ টন পোলেন সংগ্রহ করা সম্ভব।

আধুনিক এই মৌ–বাক্সের ফ্রেম বা চাক থেকে মধু সংগ্রহের প্রক্রিয়াতেও এসেছে পরিবর্তন। আগে বিভিন্ন রকম ময়লা–আবর্জনা, ঝুট কাপড়ে আগুন লাগিয়ে ধোঁয়া তৈরি করে চাক থেকে মৌমাছিদের সরিয়ে মধু সংগ্রহ করা হতো। বর্তমানে নতুন এই মৌ–বাক্সে একটি ছোট হাওয়া মেশিনে নারকেলের ছোবড়া ঢুকিয়ে তাতে আগুন দিয়ে ধোঁয়া তৈরি করা হয়ে থাকে। আগে টিন বা প্লেইন শিটের তৈরি মধুনিষ্কাশন যন্ত্রের মধ্যে চাক রেখে মধু সংগ্রহ করা হতো। বর্তমানে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত স্টিলের তৈরি মধুনিষ্কাশন যন্ত্রের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করা হচ্ছে।

মধু সংগ্রহে আসা মৌচাষিদের সহযোগিতা করছেন লিচুচাষি ও বাগানমালিকেরা। বিরল উপজেলার মাধববাটি এলাকার বাগানমালিক আনোয়ারুল ইসলাম, চিরিরবন্দর উপজেলার চকমুসা বিলপাড়া এলাকার লিচুচাষি ওয়াদুদ রহমানসহ আরও কয়েকজন জানান, মৌমাছির দ্বারা ফুলের পরাগায়নের ফলে লিচুর ফলন বাড়ে। লিচু আকারে বড় হয়, রোগবালাইও কম হয়।

মৌচাষিরা জানান, দিনাজপুরে ১৫ হাজারের বেশি মৌ–বাক্সে মৌ চাষ হচ্ছে। একটি মৌ-বাক্স থেকে প্রতিবছর গড়ে ৮০-১০০ কেজি পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করা যায়। সপ্তাহে এক দিন তাঁরা বাক্স থেকে মধু সংগ্রহ করে থাকেন।