সম্রাটের সহযোগী 'গ্লাস বয়' জাকির দুদকের রিমান্ডে

জাকির হোসেন
জাকির হোসেন

যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী জাকির হোসেনকে চার দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আজ রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন দুদকের সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে দুপুরে তাঁকে সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আনা হয়। দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাঁকে রমনা থানা হেফাজতে পাঠানো হয়। কাল সোমবার সকালে আবারও তাঁকে দুদকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

যুবলীগের সাবেক নেতা জাকির হোসেনের সাড়ে ৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়ে গত ১৩ নভেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ওই মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে আনা হয়েছে। এ ছাড়া ৪ কোটি টাকারও বেশি সম্পদের তথ্য পেয়ে জাকিরের স্ত্রী আয়েশা আক্তার সুমা ওরফে মোসাম্মৎ সোমার বিরুদ্ধেও আলাদা মামলা করেছে দুদক।

দুদক ও যুবলীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জাকির হোসেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সদ্য সাবেক কমিটির নির্বাহী সদস্য ছিলেন। জাকির একসময় কাকরাইলের পায়েল হোটেল ও ম্যাডোনা হোটেলের গ্লাস বয় ছিলেন। সেই চাকরি ছেড়ে তিনি একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানে পিয়নের চাকরি নেন। সেখান থেকেই ঘনিষ্ঠতা বাড়ে সম্রাটের সঙ্গে। সূত্র আরও জানিয়েছে, জাকির সম্রাটের খুবই বিশ্বস্ত। সম্রাট যাঁদের দিয়ে ক্যাসিনো ব্যবসা চালাতেন, তাঁদের মধ্যে জাকির অন্যতম। সূত্র বলছে, সম্রাটের ক্যাসিনো–বাণিজ্যের অঢেল টাকার একটি বড় অংশ গচ্ছিত আছে জাকিরের কাছে। সেসব বিষয়ে তথ্য জানতে জাকিরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গত বছরের ২৯ অক্টোবর ভোলা থেকে গ্রেপ্তার হন জাকির।

জাকিরের বিরুদ্ধে মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, অনুসন্ধানের সময় বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে পাওয়া তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে চলতি, সঞ্চয়ী ও এফডিআর হিসেবে ৪ কোটি ৬৪ লাখ ৮ হাজার টাকা জমা আছে। এ ছাড়া গত করবর্ষে (২০১৮-১৯) তিনি তাঁর আয়কর নথিতে ৮৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে তাঁর মোট ৫ কোটি ৪৯ লাখ ৩ হাজার টাকা অর্জনের সুনির্দিষ্ট কোনো উৎস পাওয়া যায়নি।

এজাহারে আরও বলা হয়, ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা থেকে জাকিরের অবৈধ আয়ের অর্থ দিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকাসহ দেশের বাইরে বিপুল সম্পদ অর্জনের তথ্য দুদকের হাতে আছে। মামলার তদন্তের সময় প্রমাণ সংগ্রহের মাধ্যমে সেগুলো আমলে নেওয়া হবে।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জাকিরের নামে কেনা সম্পদের তথ্য দুদকের হাতে থাকলেও এখন পর্যন্ত সে–সংক্রান্ত নথি হাতে পায়নি সংস্থাটি। মামলার তদন্তের সময় বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়ে ওই সব সম্পদের মালিকানার বিষয়ে নিশ্চিত হবে সংস্থাটি। সূত্রটি বলছে, রাজধানীর পুরানা পল্টন ও বিজয়নগরে তাঁর তিনটি বাড়ি আছে। রাজধানীর শান্তিনগর, সেগুনবাগিচা, বিজয়নগর ও সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় ফ্ল্যাট আছে ২৮টি। গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে আছে ১০০ কাঠা জমি। কাকরাইলের ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারের যে ভবনটিকে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট তাঁর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতেন, ওই ভবনের চতুর্থ তলাও জাকিরের কেনা। সেখানেই প্রথম সম্রাট তাঁর অফিস করতেন। পরে ওই ভবনের অন্য তলাগুলোও দখলে নেওয়া হয়।

অন্যদিকে, জাকিরের স্ত্রীর নামে যেসব সম্পদ পাওয়া গেছে, তার সবই জাকিরের বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আয়েশা একজন গৃহিণী। তিনি বিভিন্ন অবৈধ উপায়ে ৪ কোটি ৬৩ লাখ ১৩ হাজার ৩০০ টাকার অবৈধ সম্পদ জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণভাবে অর্জন করে তা নিজ ভোগদখলে রেখেছেন।

দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৮–১৯ করবর্ষ পর্যন্ত আয়েশা আক্তারের নামে ১ কোটি ৪৮ লাখ ৩০ হাজার ৭৮৮ টাকার স্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া অনুসন্ধানে আয়েশার নামে সূত্রাপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের একটি সাবকবলা দলিলের মাধ্যমে ২৯৩ দশমিক ৫০ অযুতাংশ জমি কেনার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। জমিটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের পুরানা পল্টন লাইনে অবস্থিত। সরেজমিনে পরিদর্শনে দুদক দেখেছে, ওই জমিতে একটি সাততলা বাড়ি আছে, যার আনুমানিক নির্মাণ ব্যয় প্রায় ১ কোটি টাকা। জমি এবং জমিতে নির্মাণ করা ভবনের তথ্য তিনি আয়কর নথিতে প্রদর্শন না করে গোপন করেছেন। অসুসন্ধানে আয়েশার স্থাবর সম্পদের দলিলমূল্য ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৬২ হাজার ৭৮৮ টাকা পাওয়া গেলেও প্রকৃতপক্ষে ওই সম্পদের দাম আরও বেশি হবে বলে মনে করছে দুদক। ওই সব সম্পদ অর্জনের কোনো বৈধ উৎস পায়নি দুদক। স্থাবর অস্থাবর মিলিয়ে আয়েশার ৪ কোটি ৬৩ লাখ ১৩ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ পেয়েছে দুদক।

গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে প্রথম দিনই রাজধানীর ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক (পরে বহিষ্কার করা হয়) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন অভিযানে একে একে গ্রেপ্তার হন যুবলীগের কথিত নেতা ও ঠিকাদার এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম, মোহামেডান ক্লাবের ডাইরেক্টর ইনচার্জ মো. লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, সম্রাটের সহযোগী এনামুল হক আরমান, জাকির হোসেন, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি মোহাম্মদ শফিকুল আলম ফিরোজ, অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ও তারেকুজ্জামান রাজীব।

গ্রেপ্তার হওয়া এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বিপুল অর্থের মালিক হওয়া, অর্থ পাচারসহ নানা অভিযোগ ওঠে। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁদের অপকর্মে সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সাংসদ, রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্নজনের নাম উঠে আসে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তের পাশাপাশি এঁদের অবৈধ সম্পদের খোঁজে মাঠে নামে দুদক। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনো-কাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়। পরে আরও দুজনকে দলে যুক্ত করা হয়। দলের অন্য সদস্যরা হলেন উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম, মো. সালাহউদ্দিন, সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী, সাইফুল ইসলাম, আতাউর রহমান ও মোহাম্মদ নেয়ামুল আহসান গাজী।

অনুসন্ধান দলের সদস্যরা গণমাধ্যমে আসা বিভিন্ন ব্যক্তির নাম যাচাই-বাছাই করে একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করে। সংস্থার গোয়েন্দা শাখার পক্ষ থেকে এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়। পাশাপাশি র‍্যাব ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধানেরা দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেন। সেসব তথ্য ও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে এ পর্যন্ত ২০টি মামলা করে দুদক দল। এসব মামলা হয়েছে ঠিকাদার জি কে শামীম, যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, আওয়ামী লীগের নেতা এনামুল হক এনু ও তাঁর ভাই রুপন ভূঁইয়া, অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান, বিসিবি পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ ও এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ এবং যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সুমি রহমান এবং কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান, তারেকুজ্জামান রাজীব, যুবলীগের সাবেক প্রভাবশালী নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, এনামুল হক আরমান, জাকির হোসেন ও তাঁর স্ত্রী আয়েশা আক্তার সুমা এবং গণপূর্তের সিনিয়র সহকারী শাখাপ্রধান মুমিতুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী জেসমিন আক্তারের বিরুদ্ধে।