সময় এখন প্রকৃতির: উন্নয়নে চাই প্রকৃতিবান্ধব সমাধান

জীবনযাপনের, জীবনধারণের এবং জীবন সাজানোর বেশির ভাগ উপাদানের নিরবচ্ছিন্ন জোগানদার হলো প্রকৃতি। প্রকৃতি আমাদের কী না দেয়! খাদ্য, ফলমূল থেকে শুরু করে ওষুধ, পথ্য, পানীয়, কাপড়, বাড়িঘর নির্মাণের উপাদান প্রকৃতি থেকে আসে।

কোটি কোটি মানুষের শ্বাস নেওয়ার জন্য অক্সিজেন জোগান দেওয়া ,জীবন-জীবিকার উপায় সৃষ্টি, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা পালন—সবকিছুই প্রকৃতির অবদান। এমনকি আমাদের ভেতরের মানবিক আবেগ আর শৈল্পিক অনুভবকে জাগিয়ে তোলার অনুপ্রেরণাও প্রকৃতি । বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস অথবা বাংলাদেশে আঘাত হানা বড় বড় সাইক্লোনের সময় সুন্দরবন এবং উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল লাখো মানুষের জীবন বাঁচাতে রক্ষাকর্তার ভূমিকা পালন করেছে। তাই এ কথা বলা বাহুল্য, প্রকৃতিতে জীবজগৎ ও উদ্ভিদ জগতের যথার্থ সহাবস্থান আর সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য মানুষের নিজের টিকে থাকার পূর্বশর্ত।

যে প্রকৃতি বা পরিবেশ বারবার আমাদের রক্ষা করছে, তাকে রক্ষা করতে আমরা কি যথেষ্ট উদ্যোগ নিতে পেরেছি? মানুষের প্রতিদিনের জীবনধারায় পরিবেশবিরোধী কার্যকলাপের ফলে সৃষ্ট দূষণে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণ-প্রকৃতির বিলুপ্তি ঘটছে, হারিয়ে যাচ্ছে প্রাণবৈচিত্র্য। আজ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, প্রবাল প্রাচীর, জলাভূমি ধ্বংসের মুখে, নদী আর সাগর তীব্র দূষণের কবলে, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল উজাড় করে গড়ে উঠছে আবাদি ভূমি, ঘটছে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ। আর এসবের মূল কারণ হিসেবে রয়েছে আমাদের ভোগবাদী আচরণ, প্রাকৃতিক সম্পদের অতি আরোহণ এবং সীমাহীন লোভ । বিদ্যমান রৈখিক অর্থনৈতিক মডেল আমাদের এগিয়ে দিচ্ছে একধরনের অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে, যাকে অন্তত টেকসই বলা চলে না।

পৃথিবী এখন ষষ্ঠবারের মতো জীববৈচিত্র্যের মহা বিলুপ্তির দোরগোড়ায়, যার ফল আমাদের সবাইকেই ভোগ করতে হবে। সামগ্রিকভাবে মানুষ পৃথিবীর স্থলজ, সামুদ্রিক এবং জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণিজগতের সামঞ্জস্য যেভাবে বিনষ্ট করে চলছে, তাতে এবার অন্যভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে। যদি আমাদের বিদ্যমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকনির্দেশনাকে পুনর্মূল্যায়ন করে পরিবেশবান্ধব আকারে আনা যায়, তবে আমরা আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে পৃথিবীকে আর জীবজগৎকে বাঁচানোর আশা করতে পারি।

এ বছরের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে আমরা নির্ধারণ করেছি 'সময় এখন প্রকৃতির'। বিশ্বকে অবশ্যই মানতে হবে যে করোনাভাইরাসের মতো বৈশ্বিক মহামারির নাটকীয় উদ্ভব ও ক্রমবিস্তারের পেছনে কোথাও না কোথাও প্রকৃতির জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ও বাস্তুসংস্থানের ক্ষয় এ সবকিছুর দীর্ঘমেয়াদি কুপ্রভাব কাজ করছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য এটাকে বলা যেতে পারে একধরনের জাগরণী সংকেত। এখনো আমরা সম্মিলিত এবং দ্রুত পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ও বিলুপ্তি প্রতিহত করতে পারি।

আইপিবিইএস ২০১৯-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ৮০ লাখ উদ্ভিদ এবং প্রাণিজ প্রজাতি বিলুপ্তির মুখোমুখি। বিলুপ্তির এ হার বাংলাদেশে ২৪ শতাংশ, যা আরও বেশি। আইইউসিএনের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১ হাজার ৬১৯ প্রজাতির প্রাণী বাংলাদেশে দ্রুতই বিলুপ্ত হয়ে যাবে । আবার জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার আরেক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ১ দশমিক ৪ শতাংশ বনাঞ্চল হারিয়ে গেছে যে হার বাংলাদেশে ২ দশমিক ৬ শতাংশ ।

এই প্রতিবেদনে জীববৈচিত্র্য হ্রাসের পাঁচটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদের অতি আহরণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও চরম আবহাওয়া এবং আগ্রাসী প্রজাতির দ্রুত বিস্তার। এ ধরনের আশঙ্কাজনক প্রবণতা অর্থনীতি, সমাজ, জনজীবন ও জীবিকা, খাদ্য সুরক্ষা, জল সুরক্ষা সেই সঙ্গে মানুষের জীবনমানকে বিপন্ন করে তুলছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাস্তুসংস্থান ঝুঁকির প্রান্তসীমায় আর তা যদি পার হয়ে যায়, তবে বাস্তুসংস্থানগুলোর কাঠামো, কার্যক্রম এবং সেবার পরিধিতে অকল্পনীয় পরিবর্তন ঘটবে। আর পরিবেশগত, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে তার গভীর নেতিবাচক কুপ্রভাব পড়বে।

মানুষের সুস্বাস্থ্য আর পৃথিবীর সুস্বাস্থ্য যে এক সূত্রে গাঁথা, তা কোভিড-১৯ মহামারি প্রমাণ করে দিল। গবেষণায় দেখা গেছে, যেকোনো সংক্রামক রোগের উত্থান ও বিস্তারের সংখ্যা তিনগুণের চেয়েও বেশি বেড়েছে এবং ১৯৮০ সাল থেকে এই রোগগুলোর দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি উৎস ছিল প্রাণিজ। এ ছাড়া জানা গেছে, মানুষের সব সংক্রামক রোগের মধ্যে ৬০ শতাংশ প্রাণিবাহিত । কোভিড-১৯, ইবোলা, এসএআরএস, সোয়াইন ও এভিয়ান ফ্লু এইচআইভিসহ প্রাণীর মাধ্যমে ছড়ায় এমন রোগের নাটকীয় বৃদ্ধি প্রাকৃতিক বাসস্থানগুলোর ধ্বংস ও অবনতি, জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুসংস্থানের পরিষেবা হ্রাস, অবৈধ শিকারসহ বিভিন্ন কারণ এবং বন্য প্রাণী শিকার এবং অদক্ষ পরিচালনায় প্রাণিসম্পদ চাষের সঙ্গে জড়িত ঝুঁকিগুলো।

বিশ্ব অর্থনীতি জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুসংস্থানের সঙ্গে জড়িত। যেমন ফসলের পরাগায়ন, জল পরিশোধন, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, কার্বন মজুত প্রভৃতি মানুষের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইপিবিইএস জানিয়েছে, জীববৈচিত্র্যের দ্বারা সরবরাহ করা পণ্য ও পরিষেবার মূল্য প্রতিবছর ১২৫-১৪০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান, যা বিশ্বব্যাপী জিডিপির আকারের দেড়গুণ বেশি। জীববৈচিত্র্য হ্রাসের ফলে ব্যয় বেশি এবং এটি আরও বাড়তে পারে। বর্তমানে বৈশ্বিক জিডিপির ০.০০২০% এরও কম জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। তবে সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ বর্তমান বিনিয়োগের চেয়ে চার গুণ বেশি প্রয়োজন। প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশের জন্য ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন এবং সরকারের বিনিয়োগ পরিকল্পনা অনুসারে সেখানে অনুদানের ঘাটতি রয়েছে ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি এখন স্পষ্ট যে জীববৈচিত্র্য ক্ষতির পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ অর্থনীতির জন্যও লাভজনক।

নিম্ন-মধ্যম আয়ের একটি জনবহুল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়নের বিষয়ে কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও সংরক্ষণের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। নীতি, নিয়ন্ত্রণ কাঠামোগুলো এবং সব ক্ষেত্রের কর্মপরিকল্পনাগুলো একযোগে প্রাকৃতিক সম্পদের অবক্ষয়ের রোধে সমন্বয় করা প্রয়োজন।

এ লক্ষ্যে জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার, বেসরকারি খাত, নাগরিক সমাজ এবং ব্যক্তিসহ সবাইকে নিয়ে সব ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা, প্রোগ্রামিং এবং বাজেট প্রক্রিয়ায় প্রকৃতিবান্ধব সমাধান নিশ্চিত করতে হবে, যা বিশেষভাবে আসন্ন অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সংযোজন করা যেতে পারে।

জাতীয় জীববৈচিত্র্য লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে সরকারকে অবিলম্বে একটি সুবিস্তৃত কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত, যা জাতীয় জীববৈচিত্র্য কৌশল এবং কর্মপরিকল্পনা (২০১৬-২০৩১), বাংলাদেশ জাতীয় সংরক্ষণ কৌশল (২০১৬) এবং বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন-২০১৭-এর ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হতে হবে।

সরকারি, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক অর্থায়নে সৃষ্ট একটি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ তহবিল গঠনের প্রয়োজন, যা প্রকৃতি ও পরিবেশবান্ধব সমাধানের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এ ছাড়া বর্তমান অর্থ ঘাটতি হ্রাস করে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। এ জাতীয় অর্থ পরিকল্পনায় ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ দরকার, যা সুনির্দিষ্ট দেশের জন্য তুলনামূলক অর্থায়ন তদারকি এবং রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে সম্ভব হতে পারে।

পরিবেশ-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি নিজেদের পরিবেশবিষয়ক রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি হিসেবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে 'প্ল্যানেটারি ইমার্জেন্সি' ঘোষণা করে, যা এসব কার্যক্রমের পরিপূরক। এ ধরনের নীতিগত হস্তক্ষেপ ছাড়াও আমাদের বিদ্যমান সব নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ মেনে চলতে এবং তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া বাজারভিত্তিক এমন কিছু উপায় (যেমন পলিউটার পে প্রিন্সিপল অথবা গ্রিন ট্যাক্স) প্রবর্তন ও প্রচলন করতে হবে। সর্বোপরি বাস্তুসংস্থানের অবক্ষয়, বনভূমি এবং জীববৈচিত্র্য ক্ষয় বন্ধে উৎসাহ প্রদান করতে হবে।

পৃথিবীর প্রাণ প্রকৃতি রক্ষার এ সময়ে বিশ্ব সম্প্রদায় একজোট হতে পারে, গড়ে তুলতে পারে জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষা তহবিল। করোনা মহামারি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে পৃথিবী নিজেই নিজেকে নিরাময় করতে পারে, আমাদের কেবল নিরাময় প্রক্রিয়াটিকে সাহায্য করতে হবে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য অনুরাগী মন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের এমন রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দরকার, যাতে করে প্রকৃতিবান্ধব সমাধানের লক্ষ্যে নীতিনির্ধারকেরা কৌশলগত পরিবর্তন আনতে পারেন। একই সঙ্গে জনসাধারণ নিজেদের প্রাণ-প্রকৃতিকে বিনষ্ট না করেই সবুজ ও স্থিতিশীল অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য দায়িত্বশীল পদক্ষেপ রাখতে পারে ।

*লেখকেরা বর্তমানে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিতে কর্মরত।

* এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকদের নিজস্ব এবং তাতে সংস্থার মতামত প্রতিফলিত হয় না।