সরকার–কেব্‌ল অপারেটর মুখোমুখি, বিপাকে দর্শক

দর্শকেরা টিভিবিমুখ হতে পারেন, আশঙ্কা কেব্‌ল অপারেটরদের।

প্রতীকী ছবি

অনুষ্ঠানের ফাঁকে বিজ্ঞাপন দেখানো বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ রাখা নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে সরকার ও কেব্‌ল অপারেটররা। সরকার বলছে, বিজ্ঞাপন ছাড়া (ক্লিন ফিড) বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচারের দায়িত্ব কেব্‌ল অপারেটর ও ডিস্ট্রিবিউটরদের। কেননা সরকার কোনো চ্যানেল বন্ধ করেনি। এরাই সম্প্রচার বন্ধ রেখেছে। অন্যদিকে কেব্‌ল অপারেটররা বলছেন, সরকারের নির্দেশনার কারণে বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ রাখা হয়েছে। কেননা বিদেশি চ্যানেলের বিজ্ঞাপন বাদ দিয়ে সম্প্রচার করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং চ্যানেল সম্প্রচারের বিষয়ে সরকারকেই করণীয় জানাতে হবে।

সরকার ও কেব্‌ল অপারেটরদের এই মুখোমুখি অবস্থানে বিপাকে পড়েছেন দেশের টেলিভিশন দর্শকেরা। তাঁরা গত শুক্রবার থেকে পছন্দের কোনো বিদেশি চ্যানেল দেখতে পারছেন না। পশ্চিম ধানমন্ডির সামিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের নীতির বাইরে গিয়ে কিছু হোক, সেটা তাঁরা চান না। তবে বিদেশি চ্যানেল দেখার সুযোগ চান। উত্তরার ফাহমিদা আনোয়ার মনে করেন, আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে দেশের মানুষকে বিদেশি চ্যানেল দেখা থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কোনো পক্ষেরই নেই।

বাংলাদেশের সম্প্রচার আইন অনুযায়ী বিজ্ঞাপনসহ কোনো বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার এ দেশে করা যাবে না। সরকার এই আইনের বাস্তবায়ন করেছে শুক্রবার থেকে। ওই দিনের শুরুতে কেব্‌ল অপারেটররা এবং ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম) সংযোগকারীরা বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেন। এতে কেব্‌ল অপারেটরদের কাছ থেকে সংযোগ নেওয়া গ্রাহকেরা বাংলাদেশি টেলিভিশন চ্যানেল ছাড়া বিদেশি কোনো চ্যানেল দর্শকেরা আর দেখতে পাচ্ছেন না। বিনোদনভিত্তিক, শিক্ষামূলক বা সংবাদভিত্তিক সব ধরনের বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ রাখা হয়েছে।

তবে বাংলাদেশে একমাত্র ডিটিএইচ সংযোগকারী আকাশ ডিটিএইচ সংবাদভিত্তিক কয়েকটি বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার করছে। এই সংযোগ যেসব গ্রাহকের বাসায় আছে তাঁরা বিবিসি, সিএনএন, আল-জাজিরা, এনএইচকে, ফ্রান্স টিভি দেখতে পাচ্ছেন।

আকাশ ডিটিএইচের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, এই চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞাপন দেখায় না। এ কারণে সম্প্রচার অব্যাহত রাখা হয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালে এই আইন হয়েছে। তবে অপারেটরদের বিজ্ঞাপন ছাড়া চ্যানেল সম্প্রচারের ব্যবস্থা করতে প্রায় দুই বছর সময় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

অবশ্য অপারেটররা এই আইন বাতিল করার কথা বলছেন। গতকাল শনিবার বনানীতে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে কেব্‌ল অপারেটরদের সংগঠনের (কোয়াব) নেতারা বলেছেন, এখন এই আইন বাস্তবায়ন করতে গেলে মানুষ টেলিভিশন-বিমুখ হবে। এই জায়গা ইন্টারনেটভিত্তিক বিনোদন মাধ্যমগুলো দখলে নিয়ে যাবে। তাঁরা বলেছেন, চ্যানেল অপারেটিং পদ্ধতি ডিজিটালাইজড (সেট টপ বক্সের মাধ্যমে সম্প্রচার) না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান ধারা অব্যাহত রাখাই ভালো।

সরকারের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, সরকার কোনো চ্যানেল বন্ধ করেনি। সরকার বলেছে, বিজ্ঞাপনহীনভাবে চ্যানেল সম্প্রচার করতে। এটা কেব্‌ল অপারেটর, ডিস্ট্রিবিউটরদের দায়িত্ব। তিনি বলেছেন, কেউ যদি দর্শককে জিম্মি করার জন্য বিজ্ঞাপন নেই এমন বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ রাখে, তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কেব্‌ল অপারেটররা বিদেশি সংবাদভিত্তিক চ্যানেলগুলো কেন দেখাচ্ছেন না জানতে চাইলে কোয়াবের সভাপতি এস এম আনোয়ার পারভেজ বলেন, বিবিসি, সিএনএনে কম হলেও কিছু বিজ্ঞাপন বা বিজ্ঞাপনভিত্তিক অনুষ্ঠান থাকে। যাচাই-বাছাই করে যেসব চ্যানেলে বিজ্ঞাপন থাকবে না, সেগুলো চালু করে দেওয়া হবে।

সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স (অ্যাটকো), বিএফইউজে–বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)। গতকাল এ নিয়ে পৃথক বিবৃতি দিয়েছেন বিএফইউজের সভাপতি মোল্লা জালাল, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আবদুল মজিদ এবং ডিইউজে সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান।

চ্যানেল ‘ক্লিন ফিড’ করবে কে?

ক্লিন ফিডের মানে হচ্ছে অনুষ্ঠানের ফাঁকে কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন দেখানো যাবে না।

ক্লিন ফিড বা বিজ্ঞাপন ছাড়া বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার হবে, এটা নতুন কোনো ধারণা নয়। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপালেও ক্লিন ফিড বা বিজ্ঞাপন ছাড়া বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার হয়। ইউরোপ-আমেরিকাতেও এটি আছে আরও আগে থেকে।

তাহলে বাংলাদেশে সমস্যা কোথায়?

বিদেশি চ্যানেল বিজ্ঞাপনমুক্ত করে দুভাবে সম্প্রচার করা যেতে পারে। এক. যেসব বিদেশি চ্যানেল বাংলাদেশে সম্প্রচার হয়, সেসব চ্যানেল বিজ্ঞাপনহীন করে ডাউনলিংক করার ব্যবস্থা করতে পারে। অর্থাৎ চ্যানেলকেই বিজ্ঞাপনমুক্ত ফিড দিতে হবে। অথবা বাংলাদেশে যারা স্যাটেলাইট থেকে চ্যানেল ডাউনলিংক করে, তারা চ্যানেলের অনুষ্ঠানের ফাঁকে থাকা বিজ্ঞাপন বাদ দিতে পারে।

কেব্‌ল অপারেটররা বলছেন, চ্যানেলগুলো বাংলাদেশের জন্য আলাদা ফিড দেবে এটা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবসম্মত নয়। এতে যদি ওই চ্যানেলের এ দেশে সম্প্রচারের ব্যাপকভাবে আর্থিক লাভের সুযোগ না থাকে, তাহলে সেটি তারা করবে না।

কোয়াবের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এ বি এম সাইফুল হোসেন জানান, তাঁরা বিদেশি চ্যানেলগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা বিজ্ঞাপনমুক্ত ফিড দিতে আগ্রহী নন। কেননা বাংলাদেশে তাদের বাজার অতটা বড় নয়।

চ্যানেলগুলো নিজেরা না করলে বাংলাদেশে যারা ডাউনলিংক করছে অর্থাৎ কেবল অপারেটর বা ডিটিএইচ সংযোগকারী ও ডিস্ট্রিবিউটরদেরই এটি করতে হবে।

কোয়াবের প্রধান এস এম আনোয়ার পারভেজ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশে সাড়ে ৪ হাজারের বেশি কেব্‌ল অপারেটর রয়েছেন। বেশির ভাগ অপারেটরের সংযোগসংখ্যা ১৫০-২০০ বা ২৫০-৩০০। চ্যানেল ক্লিন ফিড করে চালানো কেব্‌ল অপারেটরদের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি বলেন, প্রায় ৫ লাখ মানুষ এ খাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। সরকারকে এই দিকটাও বিবেচনা করা দরকার।

একসময় বিদেশি চ্যানেলে বাংলাদেশি বিজ্ঞাপন সম্প্রচারের সঙ্গে যুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, চ্যানেলের দুটি অংশ থাকে। একটি আপলিংক, অন্যদিকে ডাউনলিংক। চ্যানেলের মালিক বা ব্রডকাস্টার তাঁদের চ্যানেল স্যাটেলাইটে আপলিংক করেন। আর কেব্‌ল অপারেটররা স্যাটেলাইট থেকে তা ডাউনলিংক করেন। এর মাঝামাঝি আর কিছু নেই। বাংলাদেশের অপারেটররা সব চ্যানেল ডাউনলিংক করে যখন প্রচার তখনই সম্প্রচার (রিয়েল টাইম) করে। বিজ্ঞাপনমুক্ত করে রিয়েল টাইমে চ্যানেল সম্প্রচার করা যায় না। চ্যানেল ক্লিন ফিড করে পরে সম্প্রচার করা কেব্‌ল অপারেটরদের জন্য ব্যয়বহুল একটি বিষয়। এ কারণে তাঁরা এটা করতে চান না।

সরকারের এ ক্ষেত্রে কী ভূমিকা হতে পারে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকার হয়তো আর্থিক সহায়তা দিতে পারে। কিন্তু চ্যানেল ক্লিন ফিড করে দেওয়াটা আমি যতটুকু বুঝি সরকারের কাজ নয়। অন্যান্য দেশেও এমনটাই হয়।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিটি বিদেশি ব্রডকাস্টার বা চ্যানেল কর্তৃপক্ষ নিজ নিজ চ্যানেল বিজ্ঞাপনমুক্ত করে বাংলাদেশের জন্য ফিড দিলে কাজটা সহজ হয়ে যায়। এ জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রযুক্তিই রয়েছে।

ক্লিন ফিড না হলে ক্ষতি কোথায়?

একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের অন্যতম মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাংলাদেশে টেলিভিশন চ্যানেলের দর্শকদের মধ্যে একটি বড় অংশ ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেলের দর্শক। এ ছাড়া বিদেশি সিনেমা দেখানো হয় এমন চ্যানেলেরও দর্শক রয়েছে। এসব চ্যানেলে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। ওই বিদেশি পণ্য বাংলাদেশের বাজারেও বিক্রি হয়। সে ক্ষেত্রে এই পণ্য দিয়ে বাংলাদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না পণ্য আমদানিকারকেরা বা কম দেন। এতে দেশীয় চ্যানেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চ্যানেলগুলো নতুন বিনিয়োগে যেতে পারে না।

এ ছাড়া বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রয়োজন না হওয়ায় নতুন বিজ্ঞাপন তৈরি হয় না। বিজ্ঞাপনী সংস্থায় বিনিয়োগ হয় না। নানাবিধ খাত বিনিয়োগ-বঞ্চিত হয়।

সরকার বলছে, বিদেশি চ্যানেল বিজ্ঞাপনমুক্ত না হওয়ায় এ খাত প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

দেশের টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্সের (অ্যাটকো) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোজাম্মেল বাবু গতকাল রাতে ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিদেশি চ্যানেল বিজ্ঞাপনশূন্য না হওয়ায় বাংলাদেশের অন্তত ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়। তিনি বলেন, এর মধ্যে ভ্যাট বা অন্যান্য কর হিসেবে সরকারের প্রাপ্য থাকে এক-চতুর্থাংশ বা ৩০০ কোটি টাকা। আর বাকি অর্থ বিজ্ঞাপন হিসেবে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, পোর্টালের প্রাপ্য। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে এখন প্রায় কোনো বিদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন পাওয়া সম্ভব হয় না।