সরকারের বড় অর্জন করোনা নিয়ন্ত্রণ: রাষ্ট্রপতি

একাদশ জাতীয় সংসদের একাদশ অধিবেশনে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। ১৮ অক্টোবর, ঢাকা
ছবি: পিআইডি

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মনে করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সব ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করেছে সরকার। এ ছাড়া সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনের ক্ষেত্রে সরকারের কার্যক্রমের প্রশংসা করেছেন তিনি।


একাদশ জাতীয় সংসদের একাদশ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি এসব কথা বলেন। আজ সোমবার বিকেল সাড়ে চারটায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ বছরের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাংসদেরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে অধিবেশনে যোগ দেন।

নিয়ম অনুযায়ী বছরের প্রথম অধিবেশনের ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি। এরপর অধিবেশনজুড়ে সাংসদেরা রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনা করেন। পরে প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়। এবারও তা–ই হবে। সাধারণত বছরের প্রথম অধিবেশন দীর্ঘ হয়। তবে এবার করোনা পরিস্থিতির কারণে অধিবেশন খুব বেশি দীর্ঘ হবে না। এই অধিবেশন ১২ থেকে ১৪ কার্যদিবস চলতে পারে বলে সংসদ সচিবালয় সূত্র জানিয়েছে। করোনার সংক্রমণের কারণে সব সাংসদ একসঙ্গে অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন না। অধিবেশন শুরুর আগেই সাংসদ এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের করোনাভাইরাসের (কোভিড–১৯) সংক্রমণ শনাক্তের পরীক্ষা হয়েছে।


সংসদের অধিবেশন কক্ষে রাষ্ট্রপতির আগমনের ঘোষণা দেওয়ার পর সশস্ত্র বাহিনীর একটি বাদক দল বিউগলে ‘ফ্যানফেয়ার’ বাজিয়ে তাঁকে সম্ভাষণ জানান। সংসদকক্ষে রাষ্ট্রপতি ঢোকার পর নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় সংগীত বাজানো হয়।
করোনা পরিস্থিতি এবং অর্থনীতিতে এর প্রভাব মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও প্রণোদনার কথা তুলে ধরেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। তাঁর বক্তব্যে অর্থনীতি, বাণিজ্য-বিনিয়োগ, খাদ্য-কৃষি, পরিবেশ-জলবায়ু, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ–জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের নেওয়া কার্যক্রম ও সাফল্যের বিষয়টি উঠে এসেছে।


রাষ্ট্রপতি বলেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে ২ হাজার চিকিৎসক ও ৫ হাজার ৫৪ জন নার্স নিয়োগ করা হয়েছে। কোভিড ডেডিকেটেড (করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে) হাসপাতালগুলোতে ১০ হাজার ৫২৫টি সাধারণ শয্যা, ৬৬৬টি আইসিইউ এবং ৭৩টি ডায়ালাইসিস বেড, ৫৫৪টি ভেন্টিলেটর, ১৩ হাজার ৫১৬টি অক্সিজেন সিলিন্ডার, ৬৭৮ হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা এবং ৬৩৯টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অব লাইফ সায়েন্সেস প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরাসরি ক্রয়ের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। সরকার শিগগিরই দেশের জনগণকে কোভিড-১৯-এর টিকা দিতে পারবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

সময়োপযোগী ও আকর্ষণীয় প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার কর্মসৃজন ও কর্মসুরক্ষা, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে বলে মনে করেন রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সময়োচিত সাহসী সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ করোনা পরিস্থিতি সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া পদক্ষেপের প্রশংসা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাবে গোটা বিশ্বের মতো দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান, ক্ষুদ্র, কুটিরশিল্পসহ অর্থনীতির সব খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ দফা নির্দেশনাসহ ভার্চ্যুয়াল কনফারেন্সের মাধ্যমে নানামুখী দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে দেশের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হয়েছে। বিনা মূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রয় এবং নগদ অর্থ বিতরণসহ সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির কারণে দেশে একটি মানুষও করোনাকালে না খেয়ে থাকেনি।

রাষ্ট্রপতি বলেন, সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও উৎকর্ষ সাধন এবং প্রাজ্ঞ রাজস্বনীতি ও সহায়ক মুদ্রানীতি অনুসরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। গত এক দশকে গড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও পরপর তিন বছর ৭ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির এই ধারাবাহিক অর্জন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারিতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিছুটা হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশে। তবে একই সময়ে মাথাপিছু জাতীয় আয় ৮ দশমিক ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলারে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।


রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা আনয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে গত এক দশকে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় চার গুণ হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমরা আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে। শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যে পথে আমরা হাঁটছি, সে পথেই আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে। এ বছর মধ্য-আয়ের দেশ হিসেবে আমরা “স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী” পালন করব। তবে আমাদের লক্ষ্য ২০৪১ সালে বিশ্বসভায় একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়া।’


গণতন্ত্রায়ণ, সুশাসন ও নিরবচ্ছিন্ন আর্থসামাজিক উন্নয়নে সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণি ও পেশানির্বিশেষে ঐকমত্য গড়ে তুলতে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করার আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং জাতির অগ্রযাত্রায় সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি সরকারি দল ও বিরোধী দলনির্বিশেষে জাতীয় সংসদে যথাযথ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।
আবদুল হামিদ বলেন, দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রাকে বেগবান করতে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সুশাসন সুসংহতকরণ, গণতন্ত্রচর্চা ও উন্নয়ন কর্মসূচিতে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারের নিরলস প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে দেশ থেকে দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলের লক্ষ্যে আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।