সরকারের সদিচ্ছা ও সামাজিক আন্দোলন ধর্ষণ কমাতে পারে

নেহাল করিম

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বেশ কিছু আলোচিত ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা সামনে এসেছে। ধর্ষণ বেড়েছে, নাকি কমেছে, সেটা বড় কথা নয়। সমাজ ও রাষ্ট্র এই অপরাধগুলোকে কীভাবে দেখছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

করোনা পরিস্থিতিতে মানুষ ঘরের মধ্যে ছিল। তখন অনেক কিছুই ঘটেছে। এর কোনোটা খবর হয়েছে, কোনোটা হয়নি। এখন বিষয়গুলো বাইরে আসছে। অতীতে যেসব ধর্ষণ বা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর বিষয়ে কি সমাজ ও রাষ্ট্র যথেষ্ট ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে? উত্তরে বলতে হবে, না। সরকার ও এর প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তরিকতার অভাব ছিল। অতীতে দেখা গেছে, সরকার চাইলে বিচার হয়, না চাইলে হয় না। সব ঘটনায় সরকার সদিচ্ছা দেখায়নি। কিছু আলোচিত ঘটনায় সরকার তৎপরতা দেখিয়েছে, যেগুলো হাতে গোনা যাবে।

ধর্ষণ ও নির্যাতনের সব ঘটনাতেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে। অথচ সরকারের সুবিধাভোগী, চাটুকার ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা অপরাধ করলে অনেক সময় তা ধামাচাপা পড়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতা, নিষ্ক্রিয়তা আছে। রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয় আছে। যারা এসব অপরাধ করছে, তাদের অনেকেই মনে করে, আমার মামা চেয়ারম্যান। কারও মামা-চাচা বড় কর্তা, নেতা। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা আছে। সাক্ষীর সুরক্ষা নেই। এ জন্য হয়রানির ভয়ে অনেকেই সাক্ষী দিতে চায় না। সব মিলিয়ে সুষ্ঠু বিচারের যে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা দরকার, দেশে এর অভাব আছে।

সমাজের এই ব্যাধি হয়তো একেবারে নির্মূল করা যাবে না, তবে কমিয়ে আনা যাবে। ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে শ্রেণিভেদ করা যাবে না। ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা বিচারে সব ধরনের আইন বাংলাদেশে আছে। শুধু দরকার সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা।

চার-পাঁচ বছরের শিশুও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এ ধরনের অপরাধ যারা করে, তাদের মধ্যে মূল্যবোধের অভাব প্রকট। বিবেকবোধ কাজ করে না। এগুলোর পেছনে মানসিক বৈকল্য কাজ করে। এই বিষয়ে আরও গভীর গবেষণা দরকার। বেশির ভাগ ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটায় ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সীরা। রাষ্ট্রকে এই বিষয়ে আরও গভীর চিন্তা করে এসব অপরাধীকে নিবৃত্ত করতে হবে।

ধর্ষণ ও নির্যাতন বন্ধে সামাজিক আন্দোলন বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ক্ষোভ-বিক্ষোভ একটা সাময়িক বিষয়। অতীতেও দেখা গেছে, কিছুদিন হইচইয়ের পর তা থেমে যায়। কিন্তু সামাজিক আন্দোলন স্থায়ী বিষয়। যেমন রাষ্ট্রকে অপরাধী চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আর সমাজে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, অপরাধীকে কেউ কোনো ধরনের সহায়তা করবে না। আত্মীয়স্বজন কিংবা রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে কাছের হলেও কোনো অনুকম্পা দেখাবে না। অপরাধীকে সামাজিকভাবে বয়কট করা গেলে বেশি ফলপ্রসূ হবে।

বাংলাদেশে প্রতিটি ঘটনা নিয়ে কয়েক দিন হইচই হয়। মানুষ থেমে গেলে রাষ্ট্রও অনেকটা থেমে যায়। ক্যাসিনো-কাণ্ড কয়েক দিনের মধ্যে মিলিয়ে গেছে। এরপর এল পাপিয়া-কাণ্ড। মানুষকে জানানো হলো যে যুবলীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া বিলাসবহুল হোটেলে নারীদের অসামাজিক কাজে ব্যবহার করতেন। বিভিন্ন পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন। কিন্তু ক্যাসিনো-কাণ্ডের হোতারা কাদের টাকা দিতেন? পাপিয়ার কাছ থেকে কারা সুবিধাভোগী? এসব জিনিস জানার আগেই মিলিয়ে গেছে। ধর্ষণের বিষয়গুলোও যেন এভাবে হারিয়ে না যায়।

একসময় অ্যাসিড-সন্ত্রাস একটা বড় সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের কথা এতটা শোনা যায় না। এর কারণ হচ্ছে এর বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে ঘৃণা তৈরি হয়েছে। মানুষ সচেতন হয়েছে। অপরাধীর শাস্তিও হয়েছে। ফলে এই ব্যাধি একেবারে শেষ হয়ে না গেলেও নিয়ন্ত্রণে আছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এবং সামাজিক আন্দোলন জোরদার হলে যে অপরাধ কমে যেতে পারে, এর বড় উদাহরণ অ্যাসিড-সন্ত্রাস হ্রাস।

নেহাল করিম:সাবেক চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়