সর্বস্বান্ত জিরাতিরা খালি হাতে ফিরছে ঘরে

কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার বাড়ি বাড়ি হাওরের জিরাতি বাড়ি। এসব বাড়িতেই কৃষকেরা বছরের অর্ধেক সময় থেকে জমি চাষাবাদ করেন। ছবি: তাফসিলুল আজিজ
কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার বাড়ি বাড়ি হাওরের জিরাতি বাড়ি। এসব বাড়িতেই কৃষকেরা বছরের অর্ধেক সময় থেকে জমি চাষাবাদ করেন। ছবি: তাফসিলুল আজিজ

গতকাল মঙ্গলবার দুপুর বেলা। কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার কামালপুর সেতুর গোড়ায় গিয়ে দেখা যায়, একটি নৌকা থেকে কয়েকজন মিলে টমটমে কিছু মালামাল ভরছেন। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন কিশোরগঞ্জ সদরের বৌলাই কুড়েরপাড় এলাকার ৬৫ বছরের কৃষক হাফিজ উদ্দিন মুনশি। জানালেন, দিনরাত পরিশ্রম করে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার মোজানল হাওরে পাঁচ একর জমি পত্তন নিয়ে ধান চাষ করেছিলেন। এর আগেও ধান চাষ করেছেন। তবে এত ধান দেখেননি। কাছে যেতেই কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে যা বললেন, একটু ভালো থাকার জন্য এই বৃদ্ধ বয়সেও পরিবারের ছয়জনসহ গরু-ছাগল নিয়ে একটি ছোট্ট ঘরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাদাগাদি করে ছয় মাস থেকেছেন। বললেন, সব কষ্ট চাপিয়ে বাম্পার ফলনের আশায় যখন অপেক্ষায় রইলাম, সে সময়ই কাল হয়ে দাঁড়ায় পানি। চোখের সামনে সোনার ফসল তলিয়ে ঘরেও এখন কোমরপানি। সবকিছু ফেলে শেষ পর্যন্ত একটি পানি সেচের মেশিন ও আরেকটি ধান মাড়াইয়ের মেশিন নিয়ে পরিবার-পরিজনসহ বাড়ি ফিরলেন। 

হাফিজ উদ্দিন বললেন, ‘ছয়টি গরু ছিল। ঋণের ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে সেগুলোকে পানির ধরে বিক্রি করতে হলো। এখন নৌকাভাড়া বাবদ তিন হাজার ও টমটমের ভাড়া বাবদ ১ হাজার ৫০০ টাকাও আমার হাতে নাই।’
হাফিজ উদ্দিনের মতো এই কৃষকেরা হাওর এলাকায় জিরাতি চাষি নামে পরিচিত। কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম ও নিকলী উপজেলায় গিয়ে এসব উঁচু এলাকার কৃষক বা জিরাতি চাষিরা অস্থায়ী কাঁচা ঘর তৈরি করেন। সেখানেই চলে বসবাস, চাষাবাদ। জিরাতিরা নিজেদের বাড়ি ঘর ফেলে সুখের আশায় খড়কুটা বা টিন দিয়ে ছোট্ট কুঁড়েঘরের মতো অস্থায়ী কাঁচা ঘর তৈরি করে শীত- গরম, ঝড়-তুফান, বৃষ্টিপাত উপেক্ষা করে হাওরের মাঝখানে বছরের প্রায় অর্ধেকটা সময় কাটিয়ে দেন।
পানি শুকানোর পর কার্তিক মাসের শেষের দিকে হাওরাঞ্চল ঘুরলে সারি সারি শত শত ছোট্ট এসব জিরাতি বাড়ি চোখে পড়ে। এসব বাড়িতে কৃষকেরা বছরের কার্তিক-অগ্রহায়ণ থেকে বৈশাখ-জ্যেষ্ঠ মাস পর্যন্ত থাকেন। পরে এসব বাড়ি ভেঙে নৌকায় করে ধানসহ আবার যার যার স্থায়ী বাড়িতে চলে আসেন। জেলার করিমগঞ্জ, তাড়াইল, সদর, নিকলী ও বাজিতপুর উপজেলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার জিরাতি চাষি রয়েছে বলে কৃষকেরা জানান। প্রতিবছর হাওরাঞ্চলের কৃষকদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের গোয়ালেও হাজার হাজার মণ ধান ওঠে। কিন্তু এবার তাঁদের নিঃস্ব হয়ে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে।

নিকলী সদরের মোহরকোনা এলাকার মো. কফিল উদ্দিন জিরাতি থেকে একই হাওরে ছয় একর জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। তিনিও লগ্নির টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে চারটি গরুসহ ঘরের টিন পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়ে শূন্য হাতে ফিরে এসেছেন। একই দুঃখের কাহিনি শোনালেন, নিকলী দামপাড়া এলাকার কৃষক চান্দু মিয়া, কিশোরগঞ্জ সদরের কর্শাকড়িয়াল এলাকার মানিক মিয়া, গোলাম হোসেনসহ অন্তত ১৫ জন কৃষক। তাঁরা জানান, তাঁদের সঙ্গে এক হাওরেই প্রায় ২০০ জিরাতি চাষি ছিলেন। সব মিলিয়ে হাওরের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১৫ হাজারের মতো জিরাতি চাষি রয়েছেন; যাঁদের বেশির ভাগ অন্যের জমি টাকার বিনিময়ে পত্তন নিয়ে চাষাবাদ করে এখন প্রায় নিঃস্ব। সরকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ৫০০ টাকা ও ৩০ কেজি করে চালসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেবে। কিন্তু এসব কৃষকের প্রশ্ন, এতে তাদের নাম থাকবে কি? নাকি শুধু জমির মালিকদের তালিকাই তৈরি করা হবে?

কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সরকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের জন্য যে অনুদানের ঘোষণা দিয়েছে। সঠিকভাবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের এ তালিকা তৈরি করা হবে। এতে জিরাতি কৃষকসহ কেউ যেন বাদ না পড়ে, সেদিকে প্রশাসন নজর রাখবে। তালিকা করার সময় কার জমি কোন কৃষক চাষ করেছেন, তা সুষ্ঠুভাবে বিবেচনা করা হবে।

কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত জেলার ১৩ উপজেলায় ৫৭ হাজার ৮৮৭ হেক্টর জমির ধান পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে চাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার ৩৪১ মেট্রিক টন। টাকার হিসেবে ক্ষতি হয়েছে ৮১৭ কোটি ৩৬ লাখ ৪৪ হাজার ৪০০ টাকা। তাতে জেলার ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯২ জন কৃষক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। যদিও কৃষকদের দাবি ক্ষতির পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি।