সহযোগিতা বেড়েছে, অস্বস্তিও আছে

লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামে কামারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ৩১ জুলাই হাজারো কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো ‘আর নয় ছিটবাসী, আমরা সবাই বাংলাদেশি।’ l ফাইল ছবি
লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামে কামারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ৩১ জুলাই হাজারো কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো ‘আর নয় ছিটবাসী, আমরা সবাই বাংলাদেশি।’ l ফাইল ছবি

রাজপথের সংঘাতের মধ্য দিয়ে বছরটা শুরু হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই গত বছরের ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সব দলের অংশগ্রহণ, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ ও সুশাসন নিশ্চিত করা নিয়ে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সরব থেকেছে।
অবশ্য সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্র ও সুশাসনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক আরও সম্প্রসারিত হয়েছে।
অন্যদিকে, ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের প্রতি ভারত, চীন ও রাশিয়ার যে সমর্থন ছিল, এ বছরও তা বজায় ছিল। ভারতের বিদায়ী হাইকমিশনার পঙ্কজ সরন ঢাকা ছাড়ার আগে বেশ স্পষ্ট করেই বলে গেছেন, বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। সেটি ছিল বাস্তবতা। আর সরকারে যে থাকে, তার সঙ্গেই ভারত সম্পর্ক বজায় রাখে।
ভারতের মতো চীনও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সমর্থন করেছিল। ফলে বর্তমান সরকারের প্রতি চীনের সমর্থন অব্যাহত আছে। ধারাবাহিকভাবে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাড়ছে। পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলী টানেলের মতো বড় প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে চীন। ভারত ও চীনের মতো রাশিয়া নির্বাচন ও সরকারকে সমর্থন জানিয়েছিল এবং তা অব্যাহত আছে। অন্যদিকে, ইয়েমেনে সামরিক অভিযান এবং বছর শেষে সন্ত্রাসবিরোধী ‘সামরিক জোটে’ দ্রুত সমর্থন দেওয়ায় সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার হয়েছে।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও এ বছর জার্মানি, ফ্রান্স ও জাপানের মতো দেশগুলোর সঙ্গেও বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বেড়েছে। ঢাকায় ফ্রাংকো-জার্মান দূতাবাস উদ্বোধনের জন্য ঢাকা সফর করেন জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাংক ওয়াল্টার স্টেইনমায়ার ও ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরাঁ ফাবিউস। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপনের কাজটি পেয়েছে ফ্রান্স। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পর দেশটির অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নমন্ত্রী গার্ড মুলার বাংলাদেশ সফর করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে তিনি বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছেন। কাছাকাছি সময় বাংলাদেশ সফর যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী সন্দীপ ভার্মা। জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের মন্ত্রীরা বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের ভ্রমণ সতর্ক বার্তা জারির সময় বাংলাদেশ সফর করে এই বার্তাই দিয়েছেন নানাভাবে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান। বছরের শেষে বাংলাদেশের সঙ্গে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ পরিমাণ (৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা) ঋণ-সহায়তা চুক্তি সই করে জাপান। এ ছাড়া চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হলেও পায়রায় দেশের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজটি নেদারল্যান্ডসকে দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশকে সঙ্গে নিয়ে একটি কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে বাংলাদেশে বন্দর নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে নেদারল্যান্ডস।
অন্যদিকে, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল যাচ্ছিল। বিচারের রায় ঘোষণার পর থেকে প্রতিবারই বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে সম্পর্কটা বিষিয়ে তুলেছে পাকিস্তান। আর এ বছর বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামায়াতের নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিবৃতি দেয়। এর জের ধরে ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে বাংলাদেশ তলব করে। এর পাল্টা হিসেবে ইসলামাবাদে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে পাকিস্তান। এর সঙ্গে এ বছর জাল মুদ্রা পাচার ও জঙ্গি অর্থায়নে জড়িত থাকার অভিযোগে পাকিস্তানের দুই কূটনীতিক ও কর্মকর্তাকে পাকিস্তান ঢাকা থেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের এসব তৎপরতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ বেশ জোরালো অবস্থান নেয়।
মে মাসে ট্রলারে করে বঙ্গোপসাগর হয়ে মানব পাচারের ঘটনাগুলো প্রকাশের পর এক মানবিক সমস্যা সামনে চলে আসে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজনকে লোভ দেখিয়ে একটি চক্রের পাচারের বিষয়টি সবার নজরে আসে। বিষয়টি আঞ্চলিকভাবে মোকাবিলার জন্য জুনে ব্যাংককে থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াকে নিয়ে আলোচনায় বসতে সফল হয় বাংলাদেশ।
গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতা সম্প্রসারণ এবং বিভিন্ন পর্যায়ের সফর বিনিময় হলেও গত বছর বিশ্বের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে শুধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় এসেছিলেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি, নিউইয়র্ক, লন্ডন, জাকার্তা গেলেও একমাত্র দ্বিপক্ষীয় সফরটি হয়েছে নেদারল্যান্ডসে।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম গত বৃহষ্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জোটের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গত এক বছরে আরও শক্তিশালী হয়েছে। বছরের শুরুর দিকে আন্দোলনের নামে রাজপথে বিএনপি-জামায়াতের তাণ্ডব দেশের মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। বিদেশেও তা সমালোচিত হয়েছে। তুলনামূলকভাবে একটি নতুন গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমরাও স্বীকার করি, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করা দরকার। ২০২১ ও ২০৪১ সালে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন লক্ষ্য সামনে রেখে আমরা এগিয়ে যেতে চাই।’
চিঠি, বিবৃতি ও সিটি নির্বাচন: সংঘাতময় রাজনীতির মধ্য দিয়ে বছর শুরু হলে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন জানুয়ারির শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চিঠি লেখেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা বন্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি দুই নেত্রীকে চিঠি লেখেন। এরই ধারাবাহিকতায় তখনকার সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ঢাকায় ১৬টি দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে চিঠি লেখেন। অবশ্য কোনো চিঠির ব্যাপারেই শেষ পর্যন্ত সরকার সাড়া দেয়নি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সংলাপ নিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশ ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বিবৃতি-বক্তব্য দিয়েছে। কিন্তু ওই নির্বাচনের পর থেকে, অর্থাৎ এপ্রিলের পর থেকে এ নিয়ে কোনো পক্ষই তেমন আর উচ্চকণ্ঠ হয়নি।
জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ন কবীর গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৫ সালে বিভিন্ন দেশ ও জোটের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা দুই স্তরে বজায় থেকেছে। নির্বাচন, সুশাসন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগটা বিভিন্ন সময়ে পুনরুচ্চারিত হয়েছে। এ বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকায় একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা ছিল। বৈশ্বিক আদর্শের প্রেক্ষাপটে মানদণ্ড দিয়ে প্রশ্ন থাকলে এ বিষয়গুলো নিয়ে তারা ভবিষ্যতেও কথা বলবে। সরকারের বেশ কিছু বিষয়ে প্রশ্ন থাকলেও বিদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও বজায় থেকেছে।
সমালোচনা ও সহযোগিতা একসঙ্গেই: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা (জিএসপি), আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস কিংবা সন্ত্রাসবাদ—বিভিন্ন বিষয়ে মাঠের ও ঘরোয়া বক্তৃতায় সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীরা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় মুখর থেকেছেন। আবার কেউ প্রাসঙ্গিক আলোচনায় বাংলাদেশের রাজনীতি ও সুশাসন নিয়ে কথা তুললে এ নিয়ে নিজেদের ভিন্নমতের কথা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে দেখার বিষয় হলো, গত এক বছরে বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা সম্প্রসারণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। মে মাসে ওয়াশিংটনে দুই দেশের অংশীদারত্ব সংলাপ চলে। সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হয় নিরাপত্তা সংলাপ এবং নভেম্বরে টিকফা কাউন্সিলের বৈঠক। মাঝে সেপ্টেম্বরে রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি শারমেনের সঙ্গে দেখা করতে ওয়াশিংটন যান পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক। ডিসেম্বরে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতিবিষয়ক পরবর্তী আন্ডার সেক্রেটারি টম শেননের সংক্ষিপ্ত ঢাকা সফর দুই দেশের সম্পর্কের জন্য তাৎপর্য বহন করে।
নির্বাচন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সুশাসন—এ বিষয়গুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অবস্থান বদলায়নি। আবার দুই দেশ সম্পর্ক সম্প্রসারিত করছে। এমন প্রশ্নের উত্তরে টম শেনন ঢাকা ছাড়ার আগে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, রাজনীতি ও সুশাসন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থাপিত বক্তব্য বৈশ্বিক ও মার্কিন মূল্যবোধের ভিত্তিতে আসছে। তাই এ বিষয়গুলোতে উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত মার্কিন অবস্থান অপরিবর্তিত থাকবে।
মানবিক সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান: সাম্প্রতিক বছরগুলোর মতো ২০১৫ সালেও অনেক উষ্ণ ছিল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জুনে ঢাকায় আসার আগে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য রাজ্যসভা ও লোকসভায় সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করিয়ে নেন। দীর্ঘ ৬৮ বছর পর মানবিক সমস্যার সমাধান করেছে দুই দেশ। শেষ হয়েছে ‘ছিটের মানুষ’ নামে পরিচিত দুই দেশের আবদ্ধ মানুষের দুঃসহ যন্ত্রণা। পূর্ণতা পেয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্র। সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান সম্পর্কের জন্য এক নতুন মাইলফলক। যদিও তিস্তার মতো দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত বিষয়ের সুরাহা হয়নি।