সাংবাদিকতায় পরিবর্তনের মহাসুযোগ এসেছে

মাহ্​ফুজ আনাম বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার–এর সম্পাদক ও প্রকাশক এবং বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের সভাপতি। তিনি সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যমের নিবিড় পর্যবেক্ষক। প্রায় এক দশক ধরে সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের জন্য যেসব সমস্যা–সংকট দেখা দিয়েছে, কোভিড–১৯ মহামারির অভিঘাতে তা আরও প্রকট হয়েছে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমও এর বাইরে নেই। এই প্রেক্ষাপটে প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি এ দেশের সাংবাদিকতা এবং সংবাদমাধ্যমশিল্পের সামনের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম

মাহ্​ফুজ আনাম
ফাইল ছবি।

প্রশ্ন :

বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমের আয়ের সমস্যা শুরু হয়েছে কোভিড–১৯ মহামারি শুরুর অনেক আগেই। মহামারির ফলে এই সমস্যা সংকটের রূপ নিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এটা সাংবাদিকতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অস্তিত্বের সংকট। বাংলাদেশ তো বিশ্বের বাইরে নয়, এ দেশে সংবাদমাধ্যমের জন্য উদ্ভূত সংকট কেমন?

মাহ্​ফুজ আনাম: সংবাদপত্রের আয়ের প্রধান উৎস বিজ্ঞাপন। ডিজিটাল মাধ্যম আসার আগপর্যন্ত সংবাদপত্রই ছিল বিজ্ঞাপনের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। কিন্তু ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, বিশেষত গুগল, ফেসবুক ইত্যাদির প্রসারের ফলে সংবাদপত্রের আয়ের প্রধান উৎসটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ৬০–৭০ শতাংশ বিজ্ঞাপন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে চলে যাচ্ছে, বাকিটা নিয়েই সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। কোভিড–১৯ মহামারির ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হয়েছে। ফলে বিজ্ঞাপন থেকে আয়েও তার বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ কথাটা ঠিক যে সাংবাদিকতার ইতিহাসে এত বড় অস্তিত্বের সংকট এর আগে কখনো আসেনি। এ কথা বিশ্বের যেকোনো দেশের জন্য প্রযোজ্য, বাংলাদেশের জন্যও প্রযোজ্য।

প্রশ্ন :

তাহলে পেশাদার সাংবাদিকতা টিকবে কীভাবে? নাকি সাংবাদিকতার মৃত্যু হতে চলেছে?

মাহ্​ফুজ আনাম: না, তা মোটেও নয়; বরং সুখের বিষয় হলো, এটা পরিবর্তনের একটা মহাসন্ধিক্ষণ। সাংবাদিকতার সামনে পরিবর্তনের এক মহাসুযোগ এসেছে। ইতিমধ্যে ইউরোপ–আমেরিকায় ছাপা সংবাদপত্রের সার্কুলেশন অনেক কমে গেছে; অনেক ছাপা সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু তারা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে চলে গেছে এবং অনেক অনলাইন সংবাদমাধ্যম প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এটা হলো নবরূপে আবির্ভাব। নতুন প্রযুক্তিগত পরিবেশে সাংবাদিকতার রূপান্তরের পর্যায় শুরু হয়েছে। আমি এটাকে ইতিবাচকভাবে দেখি।

প্রশ্ন :

কিন্তু সংবাদমাধ্যমের আয়ের যে সংকট দেখা যাচ্ছে, তা দূর করার উপায় কী? মুদ্রিত মাধ্যম থেকে ডিজিটাল মাধ্যমে রূপান্তর ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তো আয় বাড়ছে না। কারণ, পাঠক অনলাইনে সংবাদমাধ্যমের কনটেন্ট পড়তে পারছে বিনা খরচে, আর অধিকাংশ বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে গুগল, ফেসবুক ইত্যাদি নন–জার্নালিস্টিক প্ল্যাটফর্মের কাছে।

মাহ্​ফুজ আনাম: মূল কথাটা হলো পরিবর্তন। পরিবর্তন শুরু হয়েছে, পরিবর্তন আরও হবে। পাঠকের পরিবর্তন, সাংবাদিকতার পরিবর্তন, সাংবাদিকদের পরিবর্তন, বিজ্ঞাপনদাতাদের পরিবর্তন—সবার ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটবে। সম্ভাব্য দৃশ্যপটটা কল্পনা করতে হবে সামগ্রিক একটা পরিবর্তনের মধ্যে। ধরা যাক, আমরা সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাল মাধ্যমে চলে গেলাম; তখন কী হবে? ধরা যাক, একজন পাঠক ডেইলি স্টার পড়েন, এখন সকালবেলা ডেইলি স্টার তাঁর ঘরে পৌঁছে যায়। তারপর পরবর্তী খবরের জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় পরদিন সকাল পর্যন্ত। কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যমে ওই পাঠককে ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবরের আপডেট দেওয়া হচ্ছে। এটা করতে কিন্তু আমাদের পত্রিকা বিতরণব্যবস্থা, হকার ইত্যাদির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না; খবরের আপডেট চলে যাচ্ছে অনলাইনে। ফলে আমাদের নিউজপ্রিন্ট, ছাপা, পত্রিকার বিতরণ ইত্যাদির খরচ বেঁচে যাচ্ছে বা অনেক কমে যাচ্ছে। ফলে সংবাদমাধ্যমের বিজনেস মডেলটা বদলে যাচ্ছে...।

প্রশ্ন :

আমার প্রশ্ন ছিল, পাঠক অনলাইনে সংবাদমাধ্যমের কনটেন্ট পড়ছেন বিনা খরচে। যা তাঁরা বিনা খরচে পাচ্ছেন, তার জন্য পয়সা খরচ করতে রাজি হবেন কেন? মানে বাংলাদেশে অনলাইন সাবস্ক্রিপশনের ভবিষ্যৎ কী?

মাহ্​ফুজ আনাম: আমার মনে হয়, ধীরে ধীরে পাঠকের মনোভাব বদলাবে, অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, এখন অনলাইনে অনেক মানুষ কেনাকাটা করছেন এবং এটা বেশ সুবিধাজনক। কিন্তু আগে আমরা এ রকম ভাবতেই পারিনি। সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রেও এটা ঘটবে। অবশ্য পাঠক বিনা পয়সায় অনলাইনে খবর পড়তে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, আমরা যদি তাদের কাছে টাকা চাই, অর্থাৎ পে–ওয়াল করি বা ডিজিটাল গ্রাহক হতে বলি, তাহলে প্রথমে হয়তো তারা আমাদের পত্রিকা অনলাইনে পড়া ছেড়ে দেবে। বিনা পয়সায় যে পত্রিকা পড়া যায়, সেটা অনলাইনে পড়বে। কিন্তু তারা আবার আমাদের পত্রিকায় ফিরে আসবে, যখন দেখবে অন্য কোথাও তারা সঠিক খবর, ভালো বিশ্লেষণী লেখা ইত্যাদি পাচ্ছে না। অর্থাৎ এখানে উন্নত মানের সাংবাদিকতার জন্য একটা বড় সুযোগ তৈরি হচ্ছে। গুণে–মানে সেরা সংবাদপ্রতিষ্ঠানের কাছেই পাঠক ফিরে আসবেন এবং পয়সা দিয়ে ডিজিটাল সাবস্ক্রাইবার হয়ে সেটার কনটেন্ট পড়বেন। এই ক্ষেত্রে সাফল্যের দুটো বড় প্রমাণ ইতিমধ্যেই আমরা দেখতে পাচ্ছি। একটা হলো যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস, এই পত্রিকা অনলাইনে পয়সা দিয়ে পড়েন ৬৫ লাখ মানুষ। অর্থাৎ তাঁরা পেয়িং সাবস্ক্রাইবার। আরেকটা বড় উদাহরণ হলো লন্ডনের গার্ডিয়ান। এ ছাড়া ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালসহ আরও অনেক সংবাদপত্রের ডিজিটাল গ্রাহকসংখ্যা বেড়েছে এবং বাড়ছে।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের বাস্তবতায় সংবাদমাধ্যমের ডিজিটাল পে–ওয়াল, অর্থাৎ পয়সা ছাড়া পড়া যাবে না—এ রকম অবস্থায় যেতে কত সময় লাগতে পারে বলে আপনার ধারণা?

মাহ্​ফুজ আনাম: সম্পূর্ণ পে–ওয়াল চালু করার আগে আমাদের বেশ ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রস্তুতিটা হলো উন্নত মানের সাংবাদিকতা নিশ্চিত করার। কারণ, মানুষ মানসম্পন্ন সংবাদমাধ্যমের কাছেই ফিরবে। পে–ওয়াল চালু করার পর পাঠক যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, তাহলে চলে গিয়ে তিনি যেন উপলব্ধি করতে পারেন যে আমি তো নির্ভুল, সঠিক, প্রয়োজনীয় তথ্য, সংবাদ, বিশ্লেষণ পাচ্ছি না। সেই মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের দক্ষ সাংবাদিক তৈরি করতে হবে, ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে, কারিগরি প্রযুক্তির দিক থেকে উৎকর্ষ সাধন করতে হবে। আমি আশাবাদী, বাংলাদেশে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সাংবাদিকতা বিকাশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে।

প্রশ্ন :

কোভিড–১৯ মহামারির কারণে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম যে সংকটে পড়েছে, এই পরিস্থিতিতে সরকারের কিছু করার আছে কি না?

মাহ্​ফুজ আনাম: নিশ্চয়ই সরকারের অনেক কিছু করার আছে। সরকার অনেক খাতে প্রণোদনা দিয়েছেন, কিন্তু সংবাদমাধ্যমের জন্য সে রকম কিছু দেননি। এমনকি আমাদের যে সরকারি বিজ্ঞাপনের পাওনা বকেয়া রয়েছে, আমরা সেটাও পাইনি। আমরা তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছি, সংবাদমাধ্যমে লিখেছি; আমরা অনুরোধ করেছি দ্রুততার সঙ্গে আমাদের পাওনা বিল পরিশোধ করতে, কিন্তু আমরা তা পাইনি। আমি মনে করি, সুষ্ঠুভাবে সমাজ ও দেশ পরিচালনায় সংবাদমাধ্যম যে ভূমিকা পালন করছে, সরকার সেটার যথাযথ মূল্যায়ন করছে না।

প্রশ্ন :

সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সরকার একটা আইনের খসড়া তৈরি করেছে, সেখানে তারা গুগল, ফেসবুক ইত্যাদি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে বলছে, ‘তোমরা সংবাদমাধ্যমের কনটেন্ট ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন পাও। সুতরাং বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া রাজস্বের একটা অংশ তোমাদের সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হবে।’ বাংলাদেশেও কি এ রকম কিছু হতে পারে না?

মাহ্​ফুজ আনাম: অবশ্যই হতে পারে এবং এটা অবধারিত। শুধু অস্ট্রেলিয়া নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নও এ রকম চিন্তাভাবনা করছে। এটা আস্তে আস্তে আসবে, এটা অবধারিত। বাংলাদেশ সরকারেরও এদিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। দেখুন, এ দেশে আমরা যখন বিজ্ঞাপন প্রকাশ করি, তখন সরকার ভ্যাট নেয়, আয়কর নেয়। কিন্তু গুগল–ফেসবুক কোনো কর না দিয়েই কোটি কোটি টাকা এ দেশ থেকে নিয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, তারা আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যমের কনটেন্ট ব্যবহার করেও বিজ্ঞাপন থেকে আয় করছে। সুতরাং এ বিষয়ে অবশ্যই কিছু করা উচিত। তাই আমাদের একটা প্রস্তাব হলো, গুগল, ফেসবুক ইত্যাদি যারাই আমাদের বিজ্ঞাপন নিচ্ছে, তাদের এই দেশে নিবন্ধিত অফিস থাকা উচিত। তখন তারা বহুজাতিক কোম্পানির মতো সব আইনকানুন মেনে এ দেশে কাজ করবে, সরকারকে কর ইত্যাদি দেবে, যেমন অন্যান্য কোম্পানি দিয়ে থাকে। এটা হলেই আমাদের সংবাদমাধ্যমের কনটেন্ট ব্যবহারের বিষয়টি আসবে। কারণ, তারা আমাদের সাংবাদিকদের তৈরি করা কনটেন্ট ব্যবহার করে মুনাফা করছে। তাহলে কেন তারা আমাদের সঙ্গে আয় ভাগাভাগি করবে না? আমাদের সরকারের অবশ্যই অস্ট্রেলিয়ার দৃষ্টান্তটি বিবেচনায় নেওয়া উচিত এবং এ দেশের গণমাধ্যমের পক্ষ থেকেও এ রকম দাবি তোলা উচিত।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মাহ্ফুজ আনাম:ধন্যবাদ।