‘সাংবাদিকের বাড়িতে পুলিশের হামলার লাইভ’, অতঃপর...

ইফতেখার আহমেদ
ছবি: সংগৃহীত

দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের সাংবাদিক ইফতেখার আহমেদ ওরফে বাবুর (৩৭) বাড়ির দরজা ভাঙার চেষ্টায় পুলিশ। ফেসবুক লাইভে যুক্ত হয়ে ইফতেখার বলছেন, সংবাদ প্রকাশের জের ধরে তাঁর বাড়িতে পুলিশ হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করছে। শেষ পর্যন্ত রাতেই ইফতেখারকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় ঘোড়াঘাট থানার পুলিশ। বুধবার রাতের এ ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

সাংবাদিক নির্যাতন করা হচ্ছে, এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার খোঁজ নিতে গিয়ে ইফতেখার বাবু সম্পর্কে বিচিত্র সব তথ্য পাওয়া গেল। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ইফতেখার বাবু প্রচলিত কোনো গণমাধ্যমে কাজ করেন না, কিন্তু তিনি নিজেকে ‘সাংবাদিক বাবু’ বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। তিনি উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্যও। পুলিশের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সখ্য রয়েছে বলেই এলাকার সবাই জানতেন। সেই সম্পর্কে হঠাৎ কী হলো তা নিয়ে কৌতূহল মানুষের মনেও।

পুলিশ বলছে, ইফতেখারের ছোট ভাইকে গত ২২ ডিসেম্বর এক বছরের কারাদণ্ড দেন একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেই থেকে তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করছেন সামাজিক মাধ্যমে। গত বুধবার রাতে পুলিশ তাঁকে ধরতে বাড়ির দরজা আটকে ফেসবুক লাইভ করা শুরু করেন ইফতেখার।

গ্রেপ্তারের পর ইফতেখারের বিরুদ্ধে ঘোড়াঘাট থানায় চোরাকারবারের অভিযোগে ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা করেছে পুলিশ। থানা সূত্র জানায়, তাঁর বাসা থেকে বৈধ কাগজপত্রবিহীন একটি প্রাইভেট কার (ঢাকা মেট্রো-গ ১২-৯৩৬২) উদ্ধার করে থানায় নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে একটি মামলা এবং পুলিশের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরেকটি মামলা করা হয়েছে।

পুলিশের ভাষ্য

ঘোড়াঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিমউদ্দিন বলেন, মুজিব বর্ষ উপলক্ষে দেশের প্রতিটি থানায় নারী-শিশু ও বয়স্কদের সেবাদানের লক্ষ্যে বিশেষ হেল্পডেস্ক ও পুলিশের বসার জন্য একটি কক্ষ নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি সব প্রক্রিয়া যথাযথভাবে সম্পন্ন করে কাজ করা হচ্ছে। ইফতেখার তাঁর ফেসবুক লাইভে এসে জানান, পুলিশ চাঁদাবাজি করে টাকা উত্তোলন করে এই কাজ করছেন।
ওসি বলেন, ইউএনওসহ ও স্থানীয় সাংসদ এই কাজে বালু ও অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতাও করেছেন। বাবুর ছোট ভাই গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই তিনি এসব মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছেন।

ইফতেখারের বাড়ি ভাঙচুর করে তাঁকে আটক করা হয়েছে, এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ওসি বলেন, ‘অপরাধী ধরতে গেলে তিনি নিশ্চয়ই সহজে ধরা দেবেন না। তাঁকে সহজভাবে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে বলা হয়েছে। কিন্তু বারান্দার দরজার তালা দিয়ে তিনি ফেসবুক লাইভে এসে মিথ্যা কথা বলেই যাচ্ছিলেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে আইনে যা বলা আছে, তা মেনেই তাঁকে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে।’

বিচিত্র তাঁর পরিচয়

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, উপজেলার ওসমানপুর এলাকার মৃত শাহাবুদ্দিন খানের বড় ছেলে ইফতেখার বাবু। ২০০৮ সালে বাড়িতে এসে থিতু হন। পরে যুবলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। স্থানীয় সাংসদ শিবলী সাদিকের ঘনিষ্ঠ এবং সাংসদের অ্যাম্বাসেডর বলেও এলাকায় নিজেকে দাবি করেন তিনি। তাঁর একটি ভিজিটিং কার্ড পাওয়া গেল। কার্ডের এক পিঠে লেখা তিনি ইট, বালু ও খোয়া সরবরাহকারী, এসএস ট্রেডার্সের মালিক। আরেক পিঠে লেখা তিনি আমার এমপি ডটকম বলে একটি সংস্থার ‘অ্যাম্বাসেডর’। সেখানে কথিত ওসমানপুর প্রেসক্লাবসহ আরও কয়েকটি সংগঠনের সঙ্গে তাঁর যুক্ততার কথাও বলা আছে। সাংবাদিক, সাংসদের অ্যাম্বাসেডর ছাড়াও এলাকায় তিনি নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য, কখনো মানবাধিকারকর্মী, শ্রমিকনেতা, ব্যবসায়ী, ফুটবল একাডেমির পরিচালক ইত্যাদি পরিচয় দিতেন। তাঁর গ্রামের লোকজন জানালেন, বছর দুয়েকের মধ্যে তাঁর পাকা বাড়ি হয়েছে, গাড়ি কিনেছেন অন্তত তিনটি।

দিনাজপুর–৬ আসনের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবু একসময় সেনাসদস্য ছিল। এলাকায় ফিরে এসে দলের জন্য কাজ করছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বিপথে চলে যায়। প্রতিনিয়ত তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনতে হয়। তাকে একাধিকবার শাসনও করা হয়েছে। তা ছাড়া তার কিছু মানসিক সমস্যাও রয়েছে।’

পুলিশের সঙ্গে সখ্য থেকে শত্রুতা

একসময় পুলিশের সঙ্গে ইফতেখারের ভালো সম্পর্কের কথা সবাই জানতেন। থানায় তদবিরসহ নানা ‘কাজকর্ম’ করে দিতেন। চলতি বছরের ২ সেপ্টেম্বর ঘোড়াঘাটের ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে ইফতেখারের ছোট ভাই ওয়াকার আহম্মেদ ওরফে নান্নুকে আটক করা হয়েছিল। ইফতেখার ও তাঁর ছোট ভাই ওয়াকার মিলে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করতেন, তৎকালীন ইউএনও ওয়াহিদা খানম তাঁদের বালু ব্যবসা বন্ধ করে দেন। সেই থেকে তাঁরা ক্ষুব্ধ হতে পারেন বলে সেই সময় সন্দেহ করা হয়েছিল। সেই ওয়াকারকে গত ২২ ডিসেম্বর এক নারীর কাছে চাঁদা দাবি, শ্লীলতাহানি ও মাদক সেবনের অপরাধে ভ্রাম্যমাণ আদালত এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। আদালত পরিচালনা করেন ঘোড়াঘাটের ইউএনও রাফিউল আলম। ভাই জেলে যাওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করতে থাকেন ইফতেখার।

বাবু একসময় সেনাসদস্য ছিল। এলাকায় ফিরে এসে দলের জন্য কাজ করছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বিপথে চলে যায়। প্রতিনিয়ত তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনতে হয়। তাকে একাধিকবার শাসনও করা হয়েছে। তা ছাড়া তার কিছু মানসিক সমস্যাও রয়েছে।
শিবলী সাদিক, দিনাজপুর–৬ আসনের সংসদ সদস্য

ইফতেখার ওরফে বাবু ফেসবুকে যেসব অভিযোগ করছিলেন, তার কেন্দ্রে রয়েছে ঘোড়াঘাট থানার অভ্যন্তরে কিছু স্থাপনা নির্মাণ। জেলা পুলিশ জানিয়েছে, থানা প্রাঙ্গণে নারী-শিশু ও বয়স্কদের সেবাদানের জন্য বিশেষ হেল্পডেস্ক ও পুলিশের বসার জন্য একটি কক্ষ তৈরি করা হচ্ছে।

সেই ঘরগুলো তৈরির জন্য পুলিশ চাঁদাবাজি করে অর্থ সংগ্রহ করছে বলে ফেসবুকে অভিযোগ করে আসছেন ইফতেখার।

থানার নির্মাণকাজ নিয়ে ঘোড়াঘাটের ইউএনও রাফিউল আলম বলেন, থানার মেরামতকাজের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকেও সহায়তা করা হয়েছে।

সেখানে সহায়তা করেছেন সাংসদ শিবলী সাদিকও। তিনি বললেন, থানায় যে নির্মাণকাজ হচ্ছে, সেখানে তিনিও সহযোগিতা করেছেন। এটা নিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ ভিত্তিহীন।

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, মূলত ইফতেখার ওরফে বাবুর ওই সব ফেসবুক পোস্টের জন্যই তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হন ওসি। বাবু কোথায় কী করেন, সবই আগে থেকেই জানে থানার সবাই। সে কারণে তাঁর বাড়িতে গিয়েই কাগজপত্র ছাড়া গাড়িটি জব্দ করতে পেরেছে পুলিশ।

এ বিষয়ে দিনাজপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি চিত্ত ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, যদি সাংবাদিকতাকে কলুষিত করে অন্যায় কাজে কেউ লিপ্ত হন, সেক্ষেত্রে তার জন্য আইন সমানভাবে প্রয়োগ হওয়া উচিৎ।