সাংস্কৃতিক মুক্তির অনন্য সংগ্রামী

সন্‌জীদা খাতুন

আজ বিশিষ্ট লেখক-শিল্পী, গুণী সংস্কৃতি-সাধক সন্‌জীদা খাতুনের ৮৮তম জন্মবার্ষিকী। আটাশিতেও তিনি দারুণ সৃষ্টিমগ্ন। এবার বইমেলাকে কেন্দ্র করে তাঁর বেশ কিছু নতুন বই প্রকাশ পেয়েছে। প্রথমা প্রকাশন থেকে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সাংস্কৃতিক মুক্তিসংগ্রাম শীর্ষক বইটি দিন কয়েক আগে প্রকাশিত হয়ে সুধী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে জীবনবৃত্ত, টুকরো লেখার ঝাঁপি, বালক রবির কীর্তিকাণ্ড, কিশোরসমগ্র ইত্যাদি বই। নিজের বইয়ের পাশাপাশি লিখলেন সাংবাদিক-রাজনীতিক-লেখক রণেশ মৈত্রের আত্মজীবনীর ভূমিকা। করোনার প্রাদুর্ভাবে সার্বক্ষণিক ঘরেই থাকতে হচ্ছে তাঁকে, তবে তাঁর গৃহবাস মানে নেহাত অবসরযাপন নয়; ছায়ানটের অনলাইন ক্লাসগুলোতে তাঁর পাঠদান দেখেশুনে তা-ই মনে হয়।

সন্‌জীদা খাতুনের রচনায় মুক্তিযুদ্ধ ফিরে ফিরে এসেছে। স্মৃতিরেখা ও চেতনার সূত্র ধরে একাত্তর তাঁর লেখায় এক অব্যাহত প্রসঙ্গের নাম।

সম্প্রতি প্রকাশিত সাংস্কৃতিক মুক্তিসংগ্রাম (প্রথমা প্রকাশন, মার্চ ২০২১) ধারণ করেছে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, বাঙালির সাংস্কৃতিক সংগ্রামের প্রামাণ্য ইতিবৃত্ত এবং মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক তাঁর একান্ত ভাবনাগুচ্ছ।

বায়ান্নর ভাষার মিছিল থেকে আজ অবধি সন্‌জীদা খাতুন প্রগতিসরণির অনলস অভিযাত্রী। একুশ তাঁকে ‘ভাষা দিয়েছে’, গত শতকের ষাটের দশকজুড়ে বুদ্ধিবৃত্তিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন তাঁকে শাণিত করেছে আর একাত্তর তাঁকে বৈরী শক্তির মুখোমুখি লড়াই করে জিততে শিখিয়েছে। এই ভূখণ্ডের বাংলা ও বাঙালিবিরোধী পাকিস্তানি কালপর্বে সন্‌জীদা খাতুন এক সাংস্কৃতিক বিদ্রোহের নাম। সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের গড়ে ওঠা সন্‌জীদা ও তাঁর সহযোদ্ধাদের সংগ্রামদীপ্ত শ্রম, মেধা ও অঙ্গীকারে। বিরুদ্ধ সময়ে, অসমসাহসে পয়লা বৈশাখে রমনার বটমূলে বাংলা বর্ষবরণ, রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনসহ বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশ-প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনের সাংস্কৃতিক ভূমি তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা ছিল তাঁর। এত সব সহ্য হওয়ার তো নয় পাকিস্তানি শাসকদের; তাই শাস্তি হিসেবে একসময়কার কলেজশিক্ষক সন্‌জীদাকে ঢাকা থেকে রংপুর বদলি করা হয়, তবু নিরস্ত হওয়ার মানুষ তো তিনি নন। তৃণমূলের সাংস্কৃতিক স্বরকে তাঁর ভবিষ্যতের বৃহৎ চলার পথের রসদ হিসেবে গ্রহণ করেন।

সাংস্কৃতিক মুক্তিসংগ্রাম সন্‌জীদা খাতুন । প্রথমা প্রকাশন

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে, মহান মার্চে রংপুর থেকে প্রথমে ঢাকায়, পরে সাভারের জিরাব গ্রাম থেকে আবার ঢাকা হয়ে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারতের আগরতলা রাজ্যে পৌঁছালেন সন্‌জীদা খাতুন ও তাঁর সাংস্কৃতিক সহযোদ্ধারা। সেখানে কিছুদিন থেকে ৫ মে কলকাতায় প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে প্রবাসে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ শুরু করেন তিনি। তাঁকে সভাপতি ও মাহমুদুর রহমান বেণুকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় ‘মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’। তাঁরই ভাষায় মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য ‘অর্থ সংগ্রহ করার উদ্যোগ ছিল এটি, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিবৃত্ত এবং পরিস্থিতি যথাযথভাবে তুলে ধরা।’ এই সংস্থারই স্মরণীয় প্রযোজনা গীতি-আলেখ্য রূপান্তরের গান; একাত্তরের কলকাতার মাঠঘাট, রাজপথে ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী শিল্পীদের বিপ্লবী-বিদ্রোহী সুর, দূর দিল্লিতে গিয়েও তাঁরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরলেন দুখিনী পূর্ব বাংলার ওপর পাকিস্তানি হায়েনাদের বর্বরতার স্বরূপ। এসব উদ্যোগের প্রেরণায়, পুরোভাগে তো সন্‌জীদা খাতুন ছিলেনই, স্বাধীনতার পরও ছায়ানট, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, কণ্ঠশীলন, ব্রতচারী আন্দোলন কিংবা নালন্দার মতো বহুমুখী শিক্ষা-সংস্কৃতিগত সামষ্টিক তৎপরতায় সুযোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক-সাম্যবাদী-আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে আটাশি বছর বয়সেও পলি সঞ্চার করে যাচ্ছেন তিনি। তাঁকে আমাদের শ্রদ্ধা।

সন্‌জীদা খাতুন মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ চলমান, কারণ, সাধারণ মানুষের সার্বিক মুক্তি এখনো অধরা। প্রতি বৈশাখে আমরা যাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে ‘অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’—এই প্রত্যাশায় বুক বাঁধি; সেই সন্‌জীদা খাতুনের স্বরে, শপথের সুরে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে একাত্তরের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার গান গাই আমরা—

‘একাত্তরের সংগ্রাম শেষ হয়নি।...দীর্ঘকাল কেটে গেছে উল্টোমুখী স্রোতে ভেসে। ফিরতি স্রোতে মুখ ঘুরিয়ে জোর সাঁতার কাটতে হবে এখন। নষ্ট সময়ের স্রোতকে প্রতিরোধ করে স্বাধীনতার মূলধারায় ফেরার কঠিন শপথ নিতে হবে আজ।’

শুভ জন্মদিন সন্‌জীদা খাতুন।