সাইকেলে এক দিনে ৪০০ কিলোমিটার পাড়ি!

যাত্রা শুরু করার সময় সেলফি। ছবি: সংগৃহীত
যাত্রা শুরু করার সময় সেলফি। ছবি: সংগৃহীত

বিদায়ের তোড়জোড় করছে কালরাত। টিপ টিপ বৃষ্টি! সাইকেলের মাথায় জ্বলজ্বল করছে আট শ, বারো শ লুমেনের এলইডি লাইটগুলো। ধবধবে সাদা আলো কালো পিচে পড়ে ঝিকমিক করছে। উত্তেজনায় ফুটছেন জনা ১২ তরুণ। খানিক পরই শুরু হয় তাঁদের রোমাঞ্চকর অভিযান।

ঘড়ির কাঁটা চারটার ঘর ছোঁয়ার পরই রাজধানীর বনানী রেলওয়ে স্টেশনের সামনে থেকে শুরু হলো আলোর মিছিলের যাত্রা, সোজা উত্তর দিকে। ধীরলয়ে এগোচ্ছে সাইকেল আরোহীদের দলটা। যেন তাড়া নেই খুব একটা। শরীরটাকে ধাতস্থ হতে দিল পরিবেশের সঙ্গে। কুড়িল উড়ালসড়ক পেছনে ফেলে ৩০০ ফুট রাস্তায় পড়ল। রাস্তা ফাঁকা, তবু স্পিডের লোভ সামলাতে হলো। অন্ধকারে বেশি দূরে দেখা যায় না। স্পিড ২৮-এর (ঘণ্টায়) ঘরে। কাঞ্চন ব্রিজ থেকে বাঁ দিকে মোড় নিল দলটা। মীরের বাজার পেরিয়ে জয়দেবপুর চৌরাস্তা। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ছটার ঘরে ঘড়ির কাঁটা। আর স্পিডোমিটার বলছে, ৬০ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়া হয়ে গেছে। বৃষ্টি ততক্ষণে ধরে এসেছে, পিচঢালা পথও শুকিয়েছে। মেঘে ঢেকে আছে সূর্য, আবহাওয়া না শীত, না গরম। সাইক্লিস্টদের কাছে এমন দিনই আরাধ্য।

‘প্রথমই বিরতিটা নিলাম আমরা ৭৫ কিলোমিটার পর।’ তানভীরকে দেখিয়ে বললেন দ্রাবিড় আলম।

পান্থপথে ক্যাফে সাইক্লিস্টসে (সিসি) বসে কথা হচ্ছিল। সন্ধ্যা নেমেছে খানিক আগেই। আমরা জনা ছয়েক মানুষ বসেছি গোল একটা টেবিল ঘিরে। গল্প হচ্ছিল গত ৪ নভেম্বরের সাইকেলের মহাকাব্যিক এক রাইড নিয়ে। শুধু কাব্য না, একেবারে মহাকাব্য! আসলেই সেদিন সাইকেলের চাকায় রাস্তায় রাস্তায় এক মহাকাব্য রচনা করে এসেছেন কয়েকজন সাইক্লিস্ট। শারীরিক সামর্থ্যের সবটুকু ভেঙেচুরে, শুধু মনের জোরে কয়েকজন তরুণ মিলে প্রায় অসাধ্যসাধন করেছেন। এক দিনে ৪০০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে এসেছেন। তা-ও আবার মহাসড়ক ধরে। গেছেন ময়মনসিংহ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নাটোরের ওপর দিয়ে। ব্যথায় আড়ষ্ট হয়ে এসেছে পা, রোড বাইকে সামনের দিকে ঝুঁকে থাকতে থাকতে বাঁকা হয়ে আসতে চেয়েছে পিঠ, ক্ষুৎপিপাসায় কাতর, সাইকেল থেকে ধুপধাপ পড়ে গেছেন কেউ কেউ, দৈত্যাকৃতির ট্রাকগুলো একেকবার পিষে মারতে চেয়েছে। তবু ক্ষান্ত হননি, প্যাডেল থামাননি। লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল, একে অন্যকে সাহস জুগিয়েছেন, আর ছুঁয়ে এসেছেন স্বপ্নের সেই মাইলফলক। অবশ্য শেষ অবধি টিকে ছিলেন ছয়জন। তাঁদেরই পাঁচজনকে নিয়ে আড্ডায় বসেছিলাম সেই সন্ধ্যায়।

এর আগে এক দিনে ৪০০ কিলোমিটার সাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতা দ্রাবিড়ের আছে। দ্রাবিড় ৪০০ কিলো চালিয়েছিলেন ২০১২-তে। সেবার ওঁরা সিলেট গিয়েছিলেন। সিলেট থেকে ওই দিনই ফেরেন ঢাকায়। সাইকেলে এক দিনে ৪০০ কিলোমিটার রুমেনও চালিয়েছেন। সে ২০১৪-এর কথা। ঢাকার ভেতরই পথটুকু পাড়ি দিয়েছিলেন।
প্রায় সবার বয়সই ত্রিশের নিচে। দু-একজন এখন ছাত্র। তেমনি একজন তানভীর আহমেদ। ইউল্যাবে পড়েন। কিছু একটা বলার জন্যই বুঝি মুখিয়ে ছিলেন এতক্ষণ। দ্রাবিড়ের মুখ থেকে ‘ও বলুক’ কথাটা রীতিমতো লুফে নিলেন, ‘হ্যাঁ, ৭৫ কিলোমিটারের পরেই আমরা প্রথম ব্রেক নিয়েছিলাম। বৃষ্টিতে ভিজে সাইকেলগুলোর চেইন শব্দ করছিল। রাস্তার পাশে নেমে লুব (চেইনে তেল দেওয়া) করে নিলাম সব কটা সাইকেল। তখন আমরা ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়েতে।’
তখনো কি সবাই একসঙ্গে ছিলেন? টেবিল ঘিরে বসে থাকা সবার উদ্দেশে ছুড়ে দিলাম প্রশ্নটা। এবার আমার বাঁ পাশে বসা দীর্ঘদেহী, সবল তরুণটি নড়ে উঠলেন। চোখ ফেরাতেই বললেন, ‘না, ততক্ষণে আমরা দুইটা গ্রুপ হয়ে গেছি।’ তাঁর নাম তাহমিদুল কবীর, ডাকনাম তন্ময়। পড়ার পাট চুকিয়েছেন সবে। তন্ময় জানালেন, শুরু থেকে ৩৭-৩৮ কিলোমিটার পর্যন্ত একত্রেই ছিলেন সবাই। পরে ‍দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে যান। যাঁরা একটু জোরে চালান এমন ছয়জন এগিয়ে গেলেন। পেছনে রইলেন ছয়।
আর দশটা লম্বা রাইডেও এমনটাই হয়। ছোট ছোট উপদলে ভাগ হয়ে যায় বড় একটা দল। যার যার মতো করে পছন্দের ইয়ার-দোস্তের সঙ্গে মিলেমিশে গল্পগুজব করতে করতে আয়েশি ভঙ্গিতে মারে প্যাডেল। সবাই কিন্তু আবার একত্রেই থাকে।

ট্রাকে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হচ্ছে সাইক্লিস্ট দল। ছবি: সংগৃহীত
ট্রাকে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হচ্ছে সাইক্লিস্ট দল। ছবি: সংগৃহীত

টিমবিডিসির এই ১২ সদস্য কিন্তু বাইক ফ্রাইডের মতো গদাইলস্করি চালে চলেন না। তির বেগে ছুটছিলেন একেকজন। সাইকেলের স্পিডোমিটার তখন ৪০ কিলোমিটারের ঘরে। সকাল আটটার দিকে আগুয়ান দল ‘টিম এ’ ময়মনসিংহের ত্রিশালে এসে থামল, নাশতা খাওয়ার বিরতি। ১০৮ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়া হয়ে গেছে। খানিকক্ষণ বিশ্রাম আর খানাপিনা চলল। ৮টা ২০ নাগাদ আবার সাইকেলে সওয়ার হলেন ‘টিম এ’র ছয়জন। ঠিক তখনই ‘টিম বি’ এসে থামল ত্রিশালের ওই রেস্তোরাঁর সামনে। কিন্তু সেদিকে তাকানোর ফুরসত কই ‘টিম এ’র সদস্যদের! সামনে আরও ৩০০ কিলোমিটার পড়ে আছে। তাই আবার ছুটলেন তাঁরা।
গরম গরম কফি এসেছে টেবিলে। ততক্ষণে জমে উঠেছে ক্যাফে সাইক্লিস্টসের আড্ডা। সবাই মন খুলে বলছেন। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা এই তরুণদের দেখে সাইক্লিস্ট ক্রিস্টোফ স্ট্রেসারের কথা মনে পড়ল। গেল বছরের মার্চে অস্ট্রিয়ার এই সাইক্লিস্ট ২৪ ঘণ্টায় ৮৯৬ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার রেকর্ডটা নিজের করে নিয়েছেন। অবশ্য স্ট্রেসার বার্লিনের পরিত্যক্ত একটা বিমানবন্দরে দিনভর চক্করের পর চক্কর লাগিয়েছিলেন। আর আমার সামনে বসা বাংলার এই ‘দামাল’ সাইক্লিস্টরা ওমন ঝা চকচকে রাস্তা পাননি। বিপৎ​সংকুল মহাসড়ক, ভাঙাচোরা, গর্তে ভরা সড়ক পেরিয়ে আসতে হয়েছে তাঁদের।
‘ভাঙাচোরা রাস্তাটা শুরু হলো ময়মনসিংহ শহরে ঢোকার একটু আগে থেকে। জায়গাটা...আ...।’ স্মার্টফোনের ম্যাপে জায়গার নাম খুঁজছিলেন দ্রাবিড়। খেই ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘...নাম খাগডহর।’
‘একদম ঠিক বলছেন ভাইয়া,’ সায় দিলেন তানভীর।
লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে খাগডহর থেকে মুক্তাগাছা বাইপাস ধরল দলটা। পুরো রাস্তা যাচ্ছেতাই। কার্পেটিং উঠে গিয়ে কোথাও কোথাও বড় বড় গর্ত হাঁ করে আছে। গোটা রাস্তায় ইট-সুড়কির টুকরো ছড়ানো। তার ওপর সাইকেলের চিকন চাকা। ঝাঁকুনি খেতে খেতে দম বেরোনোর জোগাড়। এভাবে ১০ কিলোমিটার যাওয়ার পর অবস্থার খানিক উন্নতি হলো। রাস্তা আগের চেয়ে ভালো। সকাল তখন সোয়া ১০টা। ১৫৮ কিলোমিটার চালানো হয়ে গেছে। মুক্তাগাছার গাবতলীতে এসে ছোট্ট বিরতি।

১১টার দিকে টাঙ্গাইলের মধুপুরে আনারসের বাজারে ঢুকে পড়ল সাইকেল আরোহীর দলটি। সাইকেলে বসেই সেলফি হলো একখানা। ঘণ্টা খানেক পর দুপুরের খাবারের বিরতি। ততক্ষণে তাঁরা ২০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছেন। এক ঘণ্টা পর আবার ছুটে চলা। পেছনের দলটা তখন কত দূরে—জানতে চাইলাম। আড্ডায় পরে যোগ দিয়েছিলেন সালমান সিদ্দিক। সাপোর্ট কার আগলে ছিলেন দুটি মানুষ। তাঁদের একজন এই সালমান, অপরজন জাহিদুল হক রাসেল। জবাবটা সালমানই দিলেন, ‘দুই গ্রুপের ব্যবধান ছিল কম করে হলেও ৩০ কিলোমিটার। সবারই প্রচুর পানি লাগছিল। ১২ জন মিলে সেদিন ১০০ লিটার পানি শেষ করেছে। গাড়িতে বসে ওদেরকে পানি দিতে দিতেই আমরা অস্থির।’ একসময় বঙ্গবন্ধু সেতুতে চলে এলেন সাইক্লিস্টরা। টোল প্লাজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। এক পুলিশ কর্তা ভাবলেন, সাইকেলে চেপেই বুঝি ব্রিজ পার হওয়ার ধান্দা করছেন সাইক্লিস্টরা। এসে ধরলেন। অভিপ্রায় শুনে তিনি তো মহা খুশি। একটা ট্রাক দাঁড় করিয়ে তাতে তুলে দিলেন ছয়জনকে। এরপর সেতু পার হওয়ার করুণ অভিজ্ঞতা শুনলাম তন্ময়ের মুখে। সবাই যে যাঁর মতো ট্রাকের পেছনে সাইকেল নিয়ে উঠেছেন। তন্ময় গিয়ে বসেছেন একদম চালকের পাশের আসনে। ট্রাকে ওঠার আগে তাঁদের ২২৫ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়া হয়ে গেছে।

আড্ডার ফাঁকে সবার সঙ্গে পরিচয়টা ঝালাই করে নিচ্ছিলাম। তানভীরের পাশে বসেছিলেন দাড়িমুখে ছিপছিপে গড়নের মানুষটা। নাম আরিফ হোসেন। পড়ার পাট চুকিয়েছেন সবে। এর আগে আরিফ এত দীর্ঘ রাইডে যাননি। সর্বোচ্চ ১৪৬ কিলোমিটার পর্যন্ত সাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। লম্বা রাইডের আগে যেমন প্রস্তুতি থাকা দরকার তার প্রায় কিছুই ছিল না আরিফের। প্যাডেড শর্টস পর্যন্ত পড়েননি সেদিন। থ্রি কোয়ার্টার একটা প্যান্ট পরে বেরিয়ে পড়েছিলেন।

আরিফের পাশেই বসেছিলেন রাজিবুল ইসলাম রুমেন। চাকরি করেন। নিয়মিত সাইকেল চালান। দলনেতা দ্রাবিড় নিজেও চাকরিজীবী। আর আবু ওবায়দা অপু সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। কাজ থাকায় সেদিন আড্ডায় যোগ দিতে পারেননি অপু।

ট্রাকে চড়ে সেতু পার হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা তন্ময় ও দ্রাবিড়ের মুখে শোনা গেল। চালক ছিলেন বয়সে তরুণ। যাচ্ছেতাই চালাচ্ছিলেন। একবার ব্রেক কষেন তো, পরক্ষণে এক্সেলারেটর চেপে খ্যাপা ষাঁড়ের মতো সামনে এগোন। তাঁকে কিছুতেই নিরস্ত করা যাচ্ছিল না। ওদিকে পেছনে সঙ্গী-সাথিদের অবস্থা যে কেরোসিন সেটা টের পাচ্ছিলেন তন্ময়। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। তাঁদের হাতে বিকল্প ছিল না কোনো। ‘তন্ময় তো আরামেই ছিল। আমরা না পারছিলাম দাঁড়াতে, না বসতে। ড্রাইভার এত জোরে ব্রেক কষল, আমি ট্রাকের পিঠেই দূরে গিয়ে ছিটকে পড়লাম। অন্যদের অবস্থাও সঙ্গীন।’ বলছিলেন দ্রাবিড়।

বেলা তিনটার দিকে ট্রাক থেকে নামলেন সবাই। সেতু থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে হাটিকুমরুল গোল চত্বর। সেখান থেকে ডানে গেলে বগুড়া, পশ্চিমে নাটোর। নাটোরের পথটাই বেছে নিলেন দলনেতা। সবাই নতুন উদ্যোমে শুরু করলেন। একসময় বনপাড়া-হাটিকুমরুল সড়কে এসে পড়ল দলটা। সন্ধ্যা হয় হয়, তখন বড়াইগ্রাম বাজারে এসে থামলেন সবাই। গ্রামের লোকজন এসে ছেঁকে ধরল তাঁদের। কৌতূহলী মনে নানা প্রশ্ন। কেউ জানতে চায়, ‘ভাই, আপনারা কোন বাহিনীর?’ দু-একজন তো সাইকেলের চাকা টিপেটুপে দেখে গেল। লাইটের জন্য অপেক্ষা করতে করতে একসময় সাপোর্ট কার এল। ফ্রন্ট লাইট নিয়ে আবার চলতে শুরু করল ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দলটি। ২৯১ কিলোমিটার গিয়ে ইউটার্ন নিল। সবাই তখন ক্ষুৎপিপাসায় কাতর। পথে বাজার পড়ল একটা। সন্ধ্যার পরে সচরাচর বাজারঘাট বন্ধ হয়ে যায় ওদিকে। শেষে একটা দোকানে ছোলা-পেঁয়াজু পাওয়া গেল। ক্ষুধা পেটে তাই সই। খেয়েদেয়ে পথে নামল সক্কলে। চোখধাঁধানো এলইডি লাইটের আলো তখন টিমটিম করছে। ব্যাটারির চার্জ শেষের দিকে। হাটিকুমরুল গোল চত্বর অল্প দূরে। বড়জোর ৪০০ মিটার হবে। তার আগেই বিনা মেঘে বজ্রপাত। ধুপধাপ পড়ে গেলেন সবাই। প্রথম পড়লেন তন্ময়। তারপর বাকি সবাই। কেন হঠাৎ পড়লেন, বলতে পারলেন না তন্ময়। তবে রুমেন ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন, রাস্তার একপ্রান্তে চলে গিয়েছিলেন তন্ময়। মূল রাস্তাটা একটু উঁচু। মূল রাস্তায় উঠতে গিয়েই ঘটল বিপত্তি। একেবারে চিৎপটাং। রুমেনের কথা শেষ হতেই টেবিল ঘিরে বসে থাকা সবাই একচোট হেসে নিলেন।

যাত্রাপথে সাইক্লিস্ট দল। ছবি: সংগৃহীত
যাত্রাপথে সাইক্লিস্ট দল। ছবি: সংগৃহীত

আবার হাটিকুমরুল গোল চত্বর এলেন ছয়জন। ততক্ষণে চালানো হয়েছে ৩৩৫ কিলোমিটার। ঘড়িতে রাত সাড়ে নটা বাজে। ওই মোড়েই একটা হোটেলে বসে গরুর কালা ভুনা দিয়ে পেটপুরে খেলেন সবাই। এবার সিরাজগঞ্জ থেকে বগুড়ার রাস্তায় এসে পড়লেন। রাতের বেলা ব্যস্ত মহাসড়ক। হুটহাট ট্রাকগুলো এতটাই বাঁয়ে চাপিয়ে দেয় যে রাস্তা থেকে পড়ে যাওয়ার জোগাড়। অপু তো পড়েই গেলেন একবার। ভাগ্যিস বাঁ পাশে পড়েছিলেন। ডান পাশে পড়লে বাস একেবারে চিড়েচ্যাপ্টা করে দিত।

রাত তখন ১১টা। সবাই ঘুমে কাতর। টানা উনিশ ঘণ্টার ধকল। শরীর এত সইবে কেন! স্যাডেলে বসে থাকা তখন বিরাট চ্যালেঞ্জ। শরীর ঝিমঝিম করছে। অনেকে স্যাডেল ছেড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চালাচ্ছেন। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে চালান, কয়েক সেকেন্ড বসে। ১০ কিলোমিটার পরপর বিরতি নিচ্ছিলেন সবাই। ৩৮২ কিলোমিটার এসে দ্রাবিড়ের কালো রঙের জায়ান্ট টিসিআর অ্যাডভান্সটা বিগড়ে গেল। ফ্ল্যাট হলো একটা চাকা। গোটা রাইডে একমাত্র পাংচার। একসময় তাঁদের ৪০০ কিলোমিটারের পথপরিক্রমা শেষ হলো বগুড়ার হোটেল মম ইনে এসে। তখন রাত দেড়টা।

‘টিম এ’ এসে দেখে ‘টিম বি’র সদস্যরা বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। ‘টিম বি’ বগুড়া অবধি এসে ৩০০ কিলোমিটারের একটু বেশি চালিয়ে খ্যামা দেয়। আর ‘টিম এ’ বগুড়ার দিকে না এসে সিরাজগঞ্জ থেকে নাটোর চলে গিয়েছিল। এ কারণেই তাদের ১০০ কিলোমিটার বেশি মানে ৪০০ কিলোমিটার হয়েছে। এ দলটিতে ছিলেন ইমরুল হাসান খান। তিনি বলেন, ‘সবকিছুরই তো একটা লিমিট আছে। আমরা শরীরের ওপর বাড়তি চাপ দিইনি। রাত নয়টার মধ্যে রাইড শেষ করেছি।’ আগেভাগে হোটেলে এসে ‘টিম বি’র সদস্যরা পড়েছিলেন বিড়ম্বনায়। রাতে পরে ঘুমানোর কাপড়চোপড় তো সব সাপোর্ট কারে। আর সেই প্রাইভেট কার ‘টিম এ’র সঙ্গে ঘুরছে। গত্যন্তর না দেখে যে যেভাবে পারেন সাইক্লিংয়ের জার্সি-শর্টস গায়েই ঘুম।

৪০০ শেষ করতে না পারার একটা আক্ষেপ আছে ইমরুলের মনে। তাঁর আফসোস, রাউটিংটা ঠিকমতো করা গেল, আরেকটু ভালো রাস্তা বেছে নিতে পারলে হয়তো ১২ জনই ৪০০ কিলোমিটার চালাতে পারতেন। এ রকম একটা রাইডে সবচেয়ে যে জিনিসটা বেশি দরকার, সেটা হলো আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস এ রকম যে এটা সম্ভব। বেশ জোরের সঙ্গেই বললেন ইমরুল। তাঁর মতে, আমাদের দেশ থেকে যদি নিশাত মজুমদারের মতো, মোস্তাফিজদের মতো তরুণেরা উঠে আসতে পারেন, তাহলে অন্যরাও পারবেন। সাইক্লিংয়েই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরও ভালো করবে বলে স্বপ্ন দেখেন তিনি।

ওহ, ‘টিম এ’ ৪০০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে সময় নিয়েছিল ১৫ ঘণ্টা ৪২ মিনিট। এটা তাদের স্যাডেল টাইম। মানে এই সময়টায় তাঁরা শুধু​ সাইকেল চালিয়েছেন। আর খাওয়াদাওয়া, বিশ্রাম সব মিলিয়ে সাড়ে ২১ ঘণ্টা বেরিয়ে গেছে।
৪০০ তো হলো, এবার? প্রশ্নটা করেই সবার মুখের দিকে তাকালাম একবার। দ্রাবিড়ই উত্তরটা দিলেন, ‘আগামী বছর আবার বেরোব।’ ইতিমধ্যে তারিখও ঠিক করে ফেলেছেন। ২০১৭-এর ৩ নভেম্বর, শুক্রবার। ৪০০ কিলোমিটারে, পথে পথে ঘুরবে চাকা।

৪০০ কিলোমিটারের পথপরিক্রমা ম্যাপে দেখতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন