সামরিক সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে

মো. তৌহিদ হোসেন

মাঝখানে ২০১৫ সালের নির্বাচন-পরবর্তী পাঁচ বছর বাদ দিলে ১৯৬২ সালে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমার সরাসরি সামরিক শাসনের অধীনে থেকেছে। আর প্রতিবেশী হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে একধরনের আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের মধ্যেই থেকেছে দেশটি। ফলে সোমবারের সেনা অভ্যুত্থানের কারণে এই সম্পর্কে বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসবে, এমনটা ভাবার অবকাশ নেই। তবে মিয়ানমারের সামরিক সরকার নতুন কোনো পদক্ষেপ নেয় কি না, সে সম্পর্কে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে।

মিয়ানমারে গণতন্ত্রের বিদায় নিয়ে পশ্চিমারা হতাশা প্রকাশ করলেও দেশটিতে আদৌ গণতান্ত্রিক শাসন ছিল না। কারণ, অং সান সু চির সরকারের ক্ষমতা ছিল খুবই সীমিত। দেশটির গত পার্লামেন্টের এক-চতুর্থাংশ সদস্য ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি। সামরিক পোশাকে তাঁরা পার্লামেন্টে বসতেন।

মিয়ানমারের সংবিধান সেনাপ্রধানকে একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগের ক্ষমতা দিয়েছে। প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে প্রতিনিধিত্ব করতেন সেনা কর্মকর্তারা। সব মিলিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় সেখানে সেনাপ্রধানের অনেকখানি কর্তৃত্ব ছিল। সেনাপ্রধানের ওপর ন্যূনতম কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না সরকারের। কাজেই গণতন্ত্রের নামে ছদ্মাবরণে সেনাবাহিনীই দেশটি পরিচালনা করেছে।

চার দশক ধরে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বড় জায়গাজুড়ে আছে রোহিঙ্গা সংকট। ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা ঢলের পর বিষয়টি সমাধানে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা হলেও অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসার আগে মিয়ানমারের বেসামরিক সরকার অনিবার্যভাবে সেনাবাহিনীর মতামতকে ধারণ করেই এগিয়েছে। এটা ভুলে গেলে চলবে না, শেষ দফায় রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা হয়েছে সু চির নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে। কাজেই রোহিঙ্গা প্রশ্নে দেশটির বেসামরিক সরকারের সঙ্গে সামরিক নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা আছে, এমন ভাবার সুযোগ নেই।

রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে অং সান সু চি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার সাফাই গেয়ে প্রমাণ করেছেন নিজের অবস্থানটা। কাজেই সামরিক শাসনের কারণে রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটবে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের যে আলোচনাটা চলছিল, তা হয়তো পেছাবে। সামরিক সরকার হয়তো নতুন করে সময় নেবে। সবচেয়ে বড় কথা, রোহিঙ্গারা কি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ফিরতে চাইবে। কারণ, রাখাইনে এমন কোনো পরিবেশ তো ফিরে আসেনি, যাতে রোহিঙ্গারা তাদের আদি নিবাসে ফিরতে উৎসাহিত হবে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া আরও ধীর হয়ে যেতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ের ভূরাজনীতির বিষয়টি বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে ভারত ও চীন দুই দেশের সঙ্গেই মিয়ানমার সদ্ভাব বজায় রেখে চলেছে। দুই দেশ তাদের নিজেদের স্বার্থেই মিয়ানমারের নতুন সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলবে। তবে সব মিলিয়ে চীনের ওপর মিয়ানমারের নির্ভরশীলতা বাড়বে। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য আমরা চীনকে অনুরোধ জানাতে পারি। তবে সুশাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার—এই মূল্যবোধগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পশ্চিমা দেশগুলোর অবস্থান কি হয় সেটাও দেখার আছে।

মো. তৌহিদ হোসেন: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব