সাম্প্রতিক স্বভাবের আলোকচিত্রী

রিয়াদ আবেদিন
ছবি: সংগৃহীত

রিয়াদ আবেদিনের ছবি দেখলে আপনার শীত লাগতে পারে। মনে হতে পারে, দুনিয়া থেকে রং চলে যাওয়ার সময় হয়ে এল। মনে হবে চারপাশ ধূসর হয়ে উঠেছে বুঝি। অনেক মানুষের সঙ্গেও রয়েছে যে মানুষ—নৌকা করে কোথাও যাচ্ছে সবাই—সবার মাঝখানে থেকেও একটা লোক একা।

রিয়াদ একা কালের মানুষ। এমন একটা সময় রিয়াদ ছবি তোলা শুরু করেছেন (২০১৪), যখন একা হওয়াই হালনাগাদ হওয়া। কিংবা অন্যভাবে বললে, সময়টাই এমন, কেউ আসলে কারও কাছে পৌঁছায় না এমন কালে। আড়–ঘাঁড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখা ছাড়া, সামনে আর কিছুই নেই রিয়াদের। এটা রিয়াদের কালের অনেকের কাজের মৌলিক চরিত্র।

রিয়াদের কাজ নস্টালজিক ধরনের। রঙের দুনিয়ায় রংহীন জীবন দেখি আমরা রিয়াদের কাজে। অনেক ছবি সময়কে খপ করে ধরে ফেলে, প্রায় টুটি চেপে ধরার মতো। কিন্তু রিয়াদের কাজ যেন উল্টো। মনে হয় এ ছবি যেমন আজকের হতে পারে, তেমন গতকালেরও হতে পারে। কিংবা ধরুন আরও পরের কোনো কালেরও হতে পারে।

সবুজ, অনেক সবুজ—দম বন্ধ লাগে। লাল দেখলে ভয় করে—রক্ত–রক্তও লাগতে পারে। মানুষ দেখি, কিন্তু মানুষের মুখ খুব বেশি দেখি না। ধরুন ছবিটা দেখলেন, কাউকে দেখলেন ছবির ভেতরে—কাল গুলিস্তানের মোড়ে মানুষটাকে যদি বাস্তবে দেখেন, চিনতে পারবেন বলে মনে হয় না। মানুষ যে তার পরিচয় হারাচ্ছে, এক মানুষের মুখ যে অনেক মানুষের মুখের মতো, কিংবা মুখ ও মুখোশ এক হয়ে উঠছে—রিয়াদের ছবি আপনাকে তা মনে করিয়ে দেবে।

রিয়াদের ছবি দেখলে আপনার মন খারাপ হবে। আশার আলো তাঁর ছবিতে খুব একটা নেই, যা আছে তা এক গভীর বিষাদ—যা ফেলে এসেছে তার জন্য এক গভীর নাড়িছেঁড়া টান। তাঁর কয়েকটি ছবি নিয়ে বলি: একটাতে দেখি, একটা লাল পর্দার মতো গায়ের কাঁথা ঝুলে আছে, আকাশটা নীল, আবার নীলও না; জোর করে কেউ একজন রং কেড়ে নিয়েছে ছবি থেকে। বাস্তবের বদলে রিয়াদের ছবি বাস্তব আর পরাবাস্তবের মাঝখানে দাঁড়ায়। এই কাঁথা রিয়াদের শৈশবের হতে পারে, কিংবা গ্রামের বাড়িতে রেখে আসা স্মৃতির কাঁথা হতে পারে, অথবা হতে পারে বুড়ি দাদির শেষ স্পর্শমাখা স্মৃতিচিহ্ন।

যে লোকটা লালসালুতে মুড়ে হালুয়া আর পরোটা বিক্রি করতে এসেছে বাড়ির উঠোনে, সে কবে এসে দাঁড়াল এখানে? আজ, গতকাল কিংবা আসলে একইভাবে সে দাঁড়িয়ে আছে বহুকাল ধরে—একজন ক্রেতার অপেক্ষায়, যাঁর নাম রিয়াদ, তাঁর জন্য? রিয়াদের ছবিতে হালুয়াওয়ালা অপেক্ষা করে ক্রেতার জন্য, আর আমরা যাঁরা দর্শক তাঁরা অপেক্ষা করি, ছবির ফ্রেমের মধ্যে সময় বা অন্য কারও উপস্থিতির জন্য। তবে কেউ আসে না। সাদা শার্ট পরা বুড়ো একা দাঁড়িয়ে থাকে।

রিয়াদের ‘আমার শহরের নাম ধুলো ধোয়া আর জীবন’—এই কাজটা আর যা-ই হোক, ঢাকা শহরের কথা আমাদের মনে করিয়ে দেবে না। ওই শহর দূর থেকে দেখা, যত দূর থেকে দেখলে এই মেট্রোপলিস অচেনা মনে হয় তত দূর থেকে। এই শহরটা নদীময় ছিল, যাকে আজ আমরা ঢাকা বলে জানি তার চারপাশ নদী আর খাল দিয়ে ঘেরা ছিল।

রিয়াদ আবেদিন

আলোকচিত্রী

জন্ম

১৩ এপ্রিল ১৯৯১, নোয়াখালী

পড়াশোনা

শান্ত–মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি থেকে ফ্যাশন মার্চেন্ডাইজিংয়ে স্নাতক; কাউন্টার ফটো এ সেন্টার ফর ভিজ্যুয়াল আর্টস থেকে আলোকচিত্র

বিষয়ে স্নাতকোত্তর

অর্জন

ডকুমেন্টারি ও ফটোসাংবাদিকতায়

শারজাহ আর্ট ফাউন্ডেশন থেকে ‘ভিনটেজ পয়েন্ট’ জয়ী (২০২১)

ওজনাব্রুক জাদুঘর থেকে ফেলিক্স স্কুলার ফটো অ্যাওয়ার্ডে ‘বেস্ট ইমার্জিং ফটোগ্রাফার অব দ্য ইয়ার’ মনোনয়নপ্রাপ্ত (২০২১)

সনি স্টুডেন্ট গ্রান্ট (২০২০)

রিয়াদের ছবি তাই আবার বর্তমানেরও না, কোনো এক না-জানা সময়ের—হয়তো দূর থেকে দেখা এক অচেনা নগরের। এই শহর দুরবিনে দেখা একটা শহর।

‘দিন গোনার দিন’ অতিমারিকালের গল্প। আলোকচিত্রের ইতিহাসের সবচেয়ে আশ্চর্য সময় এটা। মাধ্যম হিসেবে আলোকচিত্রের জন্মের পর থেকেই আলোকচিত্রীদের কাজের বিষয় হলো ‘অপর’। এটা প্রায় সাধারণ নিয়মের মতো, কোনো ডকুমেন্টারি আলোকচিত্রীই নিজের দিকে ক্যামেরা তাক করতেন না বা করেন না। কিন্তু এ নিয়ম বদলে যাচ্ছে, তা সময়ের ফেরে হোক বা বাধ্য হয়েই হোক, দুনিয়ার অনেক আলোকচিত্রীই এখন নিজের দিকে ক্যামেরা ঘোরাচ্ছেন। রিয়াদ তাঁদেরই একজন।

রিয়াদ আবেদিন এ বছর ৩০ ছুঁলেন। তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা নোয়াখালীতে। কাউন্টার ফটো সেন্টার ফর ভিজুয়াল আর্টস-এ আলোকচিত্র শেখার আগে তিনি শান্ত–মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফ্যাশন মার্চেন্ডাইজিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করেছেন।

স্কুল-কলেজ নোয়াখালীতে শেষ করে ভিন্ন কিছু হওয়ার আশায় ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়তে তিনি ঢাকায় আসেন। ওই ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়তে পড়তে ছবির সঙ্গে প্রেমের সূচনা। তবে ছবির প্রতি ভালোবাসার শুরু আরও আগে—কলেজের কালে ২০১০ নাগাদ। ২০১১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচিত্রতে বেসিক কোর্স। তারপর আস্তে আস্তে প্রেম গভীর হতে থাকে। ২০১৫ নাগাদ কাউন্টার ফটোর সঙ্গে যোগাযোগ। ২০১৭ সালে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন করেছেন কাউন্টার ফটো থেকে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে।

রিয়াদ ছবি তোলা শুরু করেছেন খুব বেশি দিন হয়নি, কিন্তু তিনি নিজের ছবির ভাষা খুঁজে পেয়েছেন খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। তিনি যেসব আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সনি স্টুডেন্ট গ্রান্ট। জিতেছেন ‘ইয়ান প্যারি’র মতো বিশ্ববিখ্যাত পুরস্কারও।

বলা দরকার, সনি স্টুডেন্ট গ্রান্টের অধীনে তাঁর কাজ লন্ডনের সামারসেট হাউসে প্রদর্শিত হয় গেল বছরের এপ্রিল মাসে, যা বাংলাদেশের তরুণ আলোকচিত্রীদের জন্য প্রেরণাদায়ক বটে।

এ মুহূর্তেও তাঁর দুটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী চলছে—সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজার আল–হামারিয়া স্টুডিওতে একটা, আরেকটি হলো জার্মানির ওজনাব্রুক জাদুঘরে।

রিয়াদের কাজ খুবই সাম্প্রতিক স্বভাবের। এই তরুণ আলোকচিত্রী যে সামনের দিকে যাবেন, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সময় নিয়ে তাঁর বোঝাপড়া তাঁকে অনেক দূর নিয়ে যাবে, এমন আশা দর্শক করতেই পারেন।

  • সাইফুল হক অমি: আলোকচিত্রী, চলচ্চিত্রকার ও কাউন্টার ফটোর অধ্যক্ষ