সাহসিকতার নাম নাঈমা

করোনা আক্রান্ত হয়ে আবারও চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন চিকিৎসক নাঈমা সিফাত। সম্প্রতি টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।  প্রথম আলো
করোনা আক্রান্ত হয়ে আবারও চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন চিকিৎসক নাঈমা সিফাত। সম্প্রতি টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। প্রথম আলো
>দ্বিতীয়বার করোনা জয় করে পুনরায় রোগীর সেবায় যোগ দিলেন টেকনাফ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা নাঈমা সিফাত

প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার পর ৩৬ দিনের ব্যবধানে পুনরায় সংক্রমিত হয়েছিলেন। এবারও কোভিড–১৯ রোগকে জয় করে মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় ফিরে এলেন।

এই চিকিৎসকের নাম নাঈমা সিফাত। তিনি কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা। গত বুধবার পুনরায় কাজে যোগ দেন তিনি।

গত বৃহস্পতিবার টেকনাফ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম বা পিপিই পরে হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন নাঈমা। করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সাবান দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোয়া, মুখে হাত না দেওয়াসহ রোগীদের নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছিলেন তিনি। বহির্বিভাগে আসা রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন সর্দি–জ্বরে আক্রান্ত। এদিন ২২ জনকে সেবা দেন তিনি।

নাঈমা বলেন, ‘চিকিৎসক হিসেবে কাজে যোগ দিতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, এ পেশার লক্ষ্য মানবসেবা। আমাকে দেখে আরও অনেকে সাহসী হোক।’ নাঈমার ধারণা, তিনি দুবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন নিজ কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে। টেকনাফে স্থানীয় মানুষ, বাইরের মানুষ, রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ নানা ধরনের মানুষের আনাগোনা রয়েছে। আবার রোগীদের অনেকের করোনার উপসর্গ থাকলেও চিকিৎসকের কাছে তা গোপন করেন, যা ঠিক নয়।

নাঈমা বললেন, ‘করোনায় আক্রান্ত হওয়া দোষের কিছু নয়। তবে ভয় পেলে ক্ষতি আরও বেশি।’ তিনি বলেন, করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা জন্মাবে। সে হিসেবে পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ক্ষীণ। তারপরও তিনি আক্রান্ত হন, যা অনেকটা ব্যতিক্রম ঘটনা ছিল।

নাঈমা সিফাত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫২তম ব্যাচের ছাত্রী। ৩৯তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগ দেন। সরকারি চিকিৎসক হিসেবে এটাই তাঁর প্রথম কর্মস্থল। চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের আকবর শাহ লেনের বাসিন্দা নাঈমার পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে। তাঁর প্রকৌশলী স্বামী মোহাম্মদ লোকমান ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তবে তিনি আক্রান্ত হওয়ার পর ছুটি নিয়ে চলে আসেন। তাঁদের ১৪ মাস বয়সী মেয়েকে সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করেছেন।

লোকমানের কথায়, ‘মেয়েকে মায়ের অভাব বুঝতে দিইনি। নানা ধরনের খেলনা এনে মেয়েকে খেলাধুলায় ব্যস্ত রেখেছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দিনে তিনবার বুকের দুধ পান করিয়েছি।’

গত ৩০ এপ্রিল প্রথমবারের মতো করোনায় আক্রান্ত হন নাঈমা সিফাত। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ১১ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে মায়ের বাসায় ফিরে যান। সেখানে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকার পর ২৪ মে টেকনাফে কাজে যোগ দেন। এরপর ৩ জুন পুনরায় আক্রান্ত হন তিনি। টানা ছয় দিন টেকনাফে আইসোলেশনে থাকার পর আর কোনো সমস্যা না থাকায় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বুধবার দ্বিতীয় দফায় কাজে ফেরেন নাঈমা।

মোহাম্মদ লোকমান বলেন, ‘স্ত্রী প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার পর আমার পরিবার থেকে খুব সহযোগিতা পাইনি। বাধ্য হয়ে শিশুসন্তানকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নিই। এর মধ্যে আমার শিশুকন্যাটিরও করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। তবে সৃষ্টিকর্তার রহমত যে সে আক্রান্ত হয়নি।’

নাঈমা সিফাতের প্রশংসা ঝরে পড়ল টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা টিটু চন্দ্র শীলের কণ্ঠে, ‘চিকিৎসক নাঈমা অসাধারণ সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি দুবার আক্রান্ত হওয়ার পরেও ছুটির কথা বলেননি। কাজে যোগ দিয়েছেন। তাঁকে স্যালুট জানাই।’

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত টেকনাফ থেকে ১ হাজার ৩১৩ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। বুধবার পর্যন্ত ৭৩ জনের পজিটিভ এসেছে। তাঁদের মধ্যে মারা গেছে ৩ জন। ৪ চিকিৎসকসহ ১৬ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এখনো চিকিৎসাধীন আছেন ৫২ জন।