সিনথিয়া যখন অদ্বিতীয়া

সিনথিয়া খন্দকার প্যারিসে পড়াশোনা শেষে সেখানেই একটি প্রতিষ্ঠানে বিজনেস ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ করছেন
ছবি: সংগৃহীত

২০১১ সাল। ঢাকার মিরপুরের মেয়ে সিনথিয়া সবে এইচএসসি পাস করেছেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল বাইরের জগৎ দেখার। কিন্তু টেইলর মাস্টার বাবার পক্ষে তখন মেয়ের সেই স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব ছিল না। বাস্তবতা যা-ই হোক, চেষ্টা করতে তো দোষ নেই। পত্রিকা, ইন্টারনেট ঘেঁটে, বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে খোঁজ নিতে থাকেন সিনথিয়া দেশে বা দেশের বাইরে বৃত্তি নিয়ে কোথাও পড়ার সুযোগ আছে কি না। খুঁজতে খুঁজতেই একদিন হঠাৎ চোখে পড়ে প্রথম আলোয় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) ভর্তি বিজ্ঞাপনে। পরে ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে গিয়ে জানতে পারেন বিস্তারিত।

সিনথিয়া খন্দকার ঊর্মি জানান, ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে এখানে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ আছে। বিশ্বের প্রায় ১৯টি দেশের নারী শিক্ষার্থীরা এখানে পড়াশোনা করছেন। প্রতিষ্ঠানের ৫৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষকের মধ্যে প্রায় ১০টি দেশের শিক্ষকেরা আছেন। নিজেকে তৈরি করলেন ভর্তি পরীক্ষার জন্য। কিন্তু মনের ভেতর দুশ্চিন্তার সুইটা খচখচ করেই যাচ্ছে। যদি বৃত্তি না পান? এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর খরচ জোগানোর সামর্থ্য তো তাঁর পরিবারের নেই!

একদিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ফোন করে জানাল, ‘এইউডব্লিউ-প্রথম আলো ট্রাস্ট ফার্স্ট ফিমেল ইন দ্য ফ্যামিলি শিক্ষাবৃত্তি’ নিয়ে সিনথিয়া তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন। শুনেই সিনথিয়া মাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদেছিলেন। চোখে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে ঘরের গণ্ডি থেকে বের হলেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানো পরিবারের প্রথম নারী, যাঁরা আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারছেন না, তাঁদের অনুপ্রাণিত করতে দেওয়া হয় এই শিক্ষাবৃত্তি। ২০১২ সাল থেকে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এবং প্রথম আলো ‘ফার্স্ট ফিমেল ইন দ্য ফ্যামিলি স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ নামে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান শুরু করে। ট্রান্সকমের সহায়তায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪২ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন। ২০১৭ সালে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড এই মহতী উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হলে এই শিক্ষাবৃত্তির নাম দেওয়া হয় ‘অদ্বিতীয়া’। আইডিএলসির সহায়তায় ৪৬ জনসহ ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ৮৮ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন। এর মধ্যে ছয়জন স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।

অদ্বিতীয়া সম্পর্কে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম জামালউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামাজিক উদ্যোগে আইডিএলসির অবদান দৃঢ়তর করার পথে প্রথম আলো ট্রাস্টের এই উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকতে পেরে আমরা আনন্দিত। নারীদের শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে আইডিএলসির এই ক্ষুদ্র প্রয়াস তাদের লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’

২০১৩ সালে সিনথিয়া জানতে পারেন, এইউডব্লিউর সঙ্গে ফ্রান্সের ইনস্টিটিউট অব পলিটিক্যাল সায়েন্সের একটি চুক্তি সই হয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রতিবছর দুজন শিক্ষার্থী প্যারিসে গিয়ে এক বছর পড়াশোনা করতে পারবেন। সিনথিয়া ভাবলেন, অন্যরা পারলে তিনি পারবেন না কেন। নেমে পড়লেন আরেক যুদ্ধে। বিষয়টা অত সহজ ছিল না। কারণ, তাঁর ব্যাচের ৮৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে মাত্র ২ জন এই সুযোগ পাবেন। ধাপে ধাপে পরীক্ষা দিয়ে অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দুজনের তালিকায় নিজের নাম নিশ্চিত করেন সিনথিয়া। ২০১৬ সালে প্রথম প্যারিসে যান এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে। কিন্তু সেখানে বাদ সাধল ভাষা। ফ্রান্সে যাওয়ার আগে ভেবেছিলেন, হয়তো ইংরেজিতে কাজ চালিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই বুঝে গেলেন ফ্রান্সে থাকতে হলে তাঁকে সে দেশের ভাষা শিখতে হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি খণ্ডকালীন চাকরি করতে শুরু করেন। চাকরিটা হলো, তিন বছরের এক ফরাসি বাচ্চাকে ইংরেজি শেখাতে হবে। সেই বাচ্চাকে ইংরেজি শেখালেন আর নিজে শিখলেন ফরাসি ভাষা। প্যারিসে থাকতে থাকতেই মাস্টার্সে পড়ার জন্য আবেদন করতে থাকেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ভাগ্যদেবী সদয় হলেন, আবারও সম্পূর্ণ শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে মাস্টার্স পড়ার সুযোগ পেলেন সিনথিয়া।

পড়াশোনা শেষ করে প্যারিসের দ্য ইউনিয়ন অব বিজনেস ইনকিউবেটরস নামে একটি প্রতিষ্ঠানে এখন বিজনেস ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ করছেন সিনথিয়া। তরুণদের নিয়ে কাজ করা এই প্রতিষ্ঠানের বিজনেজ ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে বিভিন্ন দাতা প্রতিষ্ঠান ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যোগাযোগের কাজটা সিনথিয়াকেই করতে হয়। অবসর সময়ে ফ্রান্সের বিখ্যাত জাদুঘর আর আল্পস পর্বতমালায় ঘুরে কাটান। ভবিষ্যতে ফ্রান্সের সংসদে নিজের জায়গা করে নিতে চান আমাদের অদ্বিতীয়া সিনথিয়া খন্দকার।

মেয়ে সিনথিয়াকে নিয়ে মা খন্দকার রহিমা আক্তারের এখন অনেক গর্ব। প্রথম আলোকে মা রহিমা বললেন, ‘আমি ছোটকাল থেকে অনেক কষ্ট করছি। এখন আমার মেয়ে যেখানে আছে, সেটা আমাকে অবাক করে, গর্বও লাগে। আমার মেয়ে কাজের খাতিরে পর্তুগাল ছাড়াও ইউরোপের আরও অনেক দেশের নারীদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে। ও যখন আমার সঙ্গে এগুলো নিয়ে গল্প করে, আমি ভাবি, আমার মেয়ে শুধু পরিবার বা দেশের না, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারীদের সাহায্য করছে। গর্বে বুক ভইরা যায়। আমি ওর জন্য প্রাণ ভইরা দোয়া করি।’

মাহবুবা সুলতানা: সমন্বয়ক, প্রথম আলো ট্রাস্ট