সিফাত হত্যা: নয় মাসেও অভিযোগপত্র দেয়নি পুলিশ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক ছাত্রী ওয়াহিদা সিফাত হত্যা মামলার নয় মাস পেরোনোর পরও অভিযোগপত্র দিতে পারেনি পুলিশ। এখন পর্যন্ত চারজন তদন্ত কর্মকর্তা বদল করা হয়েছে, কিন্তু তদন্ত এগোয়নি। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

ওয়াহিদা সিফাতের বিয়ে হয় রাজশাহী নগরের আইনজীবী মো. হোসেন রমজানের ছেলে আসিফ হোসেন ওরফে পিসলীর সঙ্গে। গত বছরের ২৯ মার্চ সন্ধ্যায় নগরের মহিষবাথান এলাকায় শ্বশুরবাড়িতে ওয়াহিদা সিফাতের মৃত্যু হয়। ঘটনার চার দিন পর ওয়াহিদার চাচা মিজানুর রহমান খন্দকার রাজপাড়া থানায় ২০ লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ এনে মামলা করেন। মামলায় ওয়াহিদার স্বামী আসিফ, শ্বশুর হোসেন রমজান ও শাশুড়ি নাজমুন নাহারকে আসামি করা হয়। এ মামলায় আসিফ কারাগারে রয়েছেন। গত বছরের ২১ অক্টোবর জামিন পান অপর দুই আসামি।
প্রথম দফা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে এবং আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ২১ জুন রংপুর মেডিকেল কলেজ মর্গে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত হয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, লাশের মাথার পেছনে ডান দিক থেকে বাঁ দিক পর্যন্ত বড় ধরনের আঘাতের চিহ্ন এবং মস্তিষ্কে রক্ত জমাটবাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়। এ কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
ওয়াহিদা সিফাত হত্যার পর নগরীর রাজপাড়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শরীফুল ইসলাম মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান। থানার পুলিশের তদন্তে অগ্রগতি না হওয়ায় মামলাটির তদন্তভার মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে দেওয়া হয়। সেখানেও অগ্রগতি না হওয়ায় পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে মামলাটি সিআইডিতে নেওয়া হয়। তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির কর্মকর্তা এনামুল হক। কিন্তু তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর এনামুলের কর্মকাণ্ড নানা বিতর্কের জন্ম দেয়।
মামলার বাদীপক্ষের অভিযোগ, গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর প্রধান আসামি আসিফকে আদালত থেকে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে সিআইডি অফিসে নেন ওই কর্মকর্তা (এনামুল)। সর্বশেষ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের না জানিয়ে তিনি তৃতীয়বারের মতো কবর থেকে মরদেহ তুলে ময়নাতদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করেন। আবেদনটি খারিজ হয়ে যায়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াহিদা সিফাতের পরিবার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে আসামির যোগসাজশের অভিযোগ তোলে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকেও এনামুলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। এরপর মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আহমেদ আলীকে। বর্তমানে তিনি মামলাটি তদন্ত করছেন।
মামলার বাদী ওয়াহিদার চাচা মিজানুর রহমান খন্দকার বলেন, আসামিপক্ষ ওয়াহিদাকে হত্যা করে পুলিশ না ডেকে নিজেরাই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাশ নিয়ে যায়। ময়নাতদন্তের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসককে প্রভাবিত করে লাশের গায়ে আঘাতের চিহ্ন থাকলেও আত্মহত্যা বলে সেই দিনই প্রতিবেদন তৈরি করানো হয়। এরপর বাদীপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয়বার রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা এনামুল হক আসামিপক্ষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তৃতীয় দফায় ময়নাতদন্তের জন্য আবেদন করেন। বাদীর অভিযোগ, ‘আসামিপক্ষ ক্ষমতাশালী হওয়ায় তারা শুরু থেকেই বিভিন্ন সময়ে মামলার তদন্তকাজ প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। এ জন্য এতগুলো তদন্ত কর্মকর্তা বদল করতে হয়েছে। ওয়াহিদার শ্বশুর আইনজীবী হওয়ায় রাজশাহীর আদালতে তাঁদের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। আমাদের পক্ষে ভালো কেনো আইনজীবীই দাঁড়াতে চান না।’
ওয়াহিদার বাবা আমিনুল ইসলাম খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মেয়েকে যে হত্যা করা হয়েছে, তা দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তে স্পষ্ট হয়েছে। ওর শ্বশুর (রমজান) ফৌজদারি আদালতের আইনজীবী হওয়ায় তিনি প্যাঁচগুলো ভালো বোঝেন। হত্যার পরে তিনি পুরো বিষয়টাকে আত্মহত্যা বলে চালানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। পরে জামিনও পেয়ে গেছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সব হারিয়েছি। পাওয়ার কিছু নেই। শুধু ন্যায়বিচারটা চাই। আমরা আসামিদের মতো ক্ষমতাশালী হলে হয়তো এত দিনে বিচার পেয়ে যেতাম।’
জানতে চাইলে এএসপি আহমেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব পেয়েছি। কাজ করছি। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।’