সুন্দরবন ঘিরে যত বিতর্ক

জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে পোল্যান্ডের ক্র্যাকো শহরে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির এ সভার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয় l ছবি: সংগৃহীত
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে পোল্যান্ডের ক্র্যাকো শহরে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির এ সভার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয় l ছবি: সংগৃহীত

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে কি হবে না-এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সরব বিতর্ক ছিল বছরজুড়ে। দেশের ভেতরে পরিবেশবাদীদের আন্দোলন ও সারা বিশ্বের পরিবেশবাদীদের উদ্বেগ উপেক্ষা করে কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিতে তৎপর ছিল সরকার। বিষয়টি নিয়ে ইউনেসকোর বিশেষ বৈঠক এবং সেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিভ্রান্তি এক নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়।

বছরের শুরুতেই রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে আলোচনা দানা বাঁধে এর ঋণচুক্তি হওয়ার পর থেকে। ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের গেলে সেখানে রামপাল প্রকল্পে অর্থায়নের ব্যাপারে দেশটির রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়। ১৬০ কোটি ডলারের এই চুক্তির মাধ্যমে প্রকল্পটির অর্থসংস্থানের বিষয় (ফাইন্যান্সিয়াল ক্লোজার) নিশ্চিত হয়। ১৮ জুলাই ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ভারত হেভি ইলেকট্রিক লিমিটেড (বিএইচইএল বা ভেল) এর মূল অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করে।
বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবিতে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির ব্যানারে পরিবেশবাদী ও বাম সংগঠনগুলো বছরের বিভিন্ন সময়ে হরতাল, অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। হরতালকারীদের ওপর পুলিশের হামলার সঙ্গে এর সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের হামলাও গণমাধ্যমে আলোচিত হয়।
এপ্রিলে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির বৈঠক বসে। কমিটি ওই প্রকল্পের ব্যাপারে আপত্তি তুলে তা বন্ধ করার সুপারিশ করে। সংস্থাটির কারিগরি কমিটির ওই সুপারিশকে বিবেচনায় নিয়ে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে পোল্যান্ডের ক্র্যাকো শহরে শুরু হয় বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভা। সেখানে সুন্দরবনসহ বিশ্বের সব কটি বিশ্ব ঐতিহ্যের সংরক্ষণ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।
ওই সভা চলাকালে ৭ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গণমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে বলা হয়, ওই সভায় রামপালের ব্যাপারে আপত্তি তুলে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তখনো সভা শেষ হয়নি। ৯ জুলাই বিদ্যুৎ ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী আবারও দাবি করেন, সরকারের দেওয়া তথ্য-উপাত্তে সন্তুষ্ট হয়ে ইউনেসকো তাদের আপত্তি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। রামপাল প্রকল্পের কাজ চলবে। তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ইউনেসকোর সিদ্ধান্তে রামপালের ব্যাপারে আপত্তি তুলে নেওয়ার কোনো কথা নেই।
তবে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলা হয়, সরকার সুন্দরবন ও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর একটি কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা করবে, আবার রামপাল প্রকল্পের কাজও এগিয়ে নেওয়া হবে।
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে গত ৭ অক্টোবর এ ব্যাপারে ইউনেসকোর অবস্থান জানতে চাওয়া হয়। ৯ অক্টোবর ই-মেইলের জবাবে ইউনেসকোর পক্ষ থেকে বলা হয়, বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপক্ষকে এই অনুরোধও জানিয়েছে যে কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা (এসইএ) সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ কোনো বড় ধরনের শিল্প এবং/বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চালাতে না দেওয়ার বিষয়টি তারা নিশ্চিত করবে।
সরকার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিলেও এর গতি ছিল ধীর। নভেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল অবকাঠামোর সাড়ে তিন শতাংশ শেষ হয়েছে। প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ পেতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে প্রায় দুই বছর বাড়তি সময় লাগবে। ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যে এর প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।