সুন্দরবনের চিত্রিতবুক কাঠঠোকরা

সুন্দরবনের পক্ষীর খালের একটি গাছে পুরুষ চিত্রিতবুক কাঠঠোকরা।
ছবি: লেখক

কম্পিউটারে ছবি খুঁজতে গিয়ে একদিন আবিষ্কার করলাম, বহুদিন আগে সুন্দরবনে পাখি পর্যবেক্ষণে গিয়ে করমজল থেকে একটি বিরল প্রজাতির পাখির ছবি তুলেছিলাম। কিন্তু ছবিতে বুক ও গলার অংশ ভালোভাবে না দেখা যাওয়ায় পাখিটিকে অন্য প্রজাতির পাখির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিলাম। যাহোক, ছবি তোলার দীর্ঘদিন পর আমার পক্ষী তালিকায় নতুন পাখি যোগ করতে পেরে আনন্দে আত্মহারা হলাম।

এর কিছুদিন পর বর্ষায় সুন্দরবনের রূপ দেখার জন্য ‘অভিযাত্রিক সুন্দরবন’-এর ব্যানারে সুন্দরবনে গেলাম। হাড়বাড়িয়া, কটকা ও জামতলী সমুদ্রসৈকতে দুই দিন ঘোরাঘুরির পর রাতে এসে পক্ষীর খালের মাথায় নোঙর করলাম। উদ্দেশ্য, শেষ দিন সকালে পক্ষীর খালের পাখি দেখে করমজল যাওয়া। ওখানে দিনের বাকি সময়টা কাটিয়ে সন্ধ্যায় মোংলায় ফিরে খুলনায় চলে যাব বাস ধরার জন্য।

পক্ষীর খালের মুখে চমৎকার একটা রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরে খালের ভেতর ঢুকলাম। খালটি বেশ সুন্দর। তবে সে তুলনায় খুব বেশি পাখি পেলাম না, নতুন পাখি তো দূরের কথা। সাত প্রজাতির সাধারণ পাখির ছবি তুলে খালের প্রায় শেষের দিকে যেই না একটা বাঁকের সামনে এসেছি, অমনি আমাদের বাঁ দিকের পাড়ের গাছ থেকে দুটি পাখি এসে ডান দিকের পাড়ের একটি গাছের কাণ্ড আঁকড়ে ধরল। ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠল। আরে, এটা তো সেই বিরল পাখি, যার ছবি করমজল থেকে তোলার বহু বছর পর শনাক্ত করতে পেরেছি। করমজলে দেখা পাখিটি ছিল স্ত্রী, আর এবারের দুটোই পুরুষ।

এতক্ষণ যে পাখির কথা বললাম, ওরা এ দেশের বিরল আবাসিক পাখি চিত্রিতবুক কাঠঠোকরা। ডোরাবুক পাকড়া কাঠঠোকরা নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম স্টিক-ব্রেস্টেড উডপেকার। পিসিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Picus viridanus। সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চল থেকে মিয়ানমার হয়ে মালয়েশিয়া উপদ্বীপ পর্যন্ত পাখিটির বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।

চিত্রিতবুক কাঠঠোকরার দৈর্ঘ্য ৩০-৩৩ সেন্টিমিটার ও ওজন ৯০-১২০ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের ওপরের অংশ হলুদাভ সবুজ। গাল ধূসর ও গোঁফরেখা কালো। অসংখ্য সাদা ছিটসহ ডানার ওড়ার পালক ও লেজ কালো। ঘাড়, গলা ও বুকের ওপরের অংশ হলুদাভ- জলপাই রঙের। সাদা আঁশের মতো ছোপসহ পেট, ডানার নিচ বা বগল ও পায়ু জলপাই রঙের। চোখ কালচে লাল। দুরঙা চঞ্চুর ওপরেরটি কালচে ও নিচেরটি হলদে। পা, পায়ের পাতা ও নখ কালচে। স্ত্রী ও পুরুষ দেখতে একই রকম হলেও পুরুষের মাথার চাঁদি লাল ও স্ত্রীরটি কালো। দাগবিহীন ঘাড়-গলা-বুক, ধূসর গাল এবং সুস্পষ্ট দুরঙা চঞ্চুর মাধ্যমে চিত্রিতগলা কাঠঠোকরা থেকে পৃথক করা যায়।

এ দেশে এদের কেবল সুন্দরবনেই দেখা যায়। সচরাচর একাকী বা জোড়ায় বিচরণ করে। গাছের কাণ্ড আঁকড়ে ধরে কিংবা মাটিতে পড়ে থাকা গাছের গুঁড়িতে লাফিয়ে লাফিয়ে

পিঁপড়া, উইপোকা, গুবরেপোকা এবং এদের ডিম ও রসাল শূককীট খুঁজে খায়।

আ ন ম আমিনুর রহমান : অধ্যাপক, বশেমুরকৃবি, গাজীপুর