সুপারিশই সার, সড়কে নৈরাজ্য চলছেই

কমিটি গঠন, সুপারিশ প্রণয়ন, পোস্টার বিতরণ ও সভা-সেমিনারেই ঘুরপাক খাচ্ছে নিরাপদ সড়ক কার্যক্রম। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মত, সুপারিশ ও আইন—সবই আছে সরকারের হাতে। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়নে সক্রিয় নয় সরকারের সংস্থাগুলো। ফলে সড়কে নৈরাজ্য চলছেই।

আজ মঙ্গলবার জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। এবার দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘জীবনের আগে জীবিকা নয়, সড়ক দুর্ঘটনা আর নয়’। এ উপলক্ষে শোভাযাত্রা, পোস্টার বিতরণ, আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচি নিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। নিরাপদ সড়কের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রীরা থাকবেন। এ জন্য গত শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনও অফিস করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সারা দেশে সংস্থাটির কার্যালয়গুলোতে এ নিয়ে কয়েক দিন ধরেই চলছে প্রস্তুতি। পোস্টার ও প্রচারপত্র ছাপানো হয়েছে লাখের ওপর। সড়ক মন্ত্রণালয় থেকে নির্মাণ করা হয়েছে সচেতনতামূলক ভিডিও। এসব পদক্ষেপ কি সড়ক দুর্ঘটনা কমাবে—এ প্রশ্নের উত্তর নেই মন্ত্রণালয়ের কাছে।

গত বছরের আগস্টে শিক্ষার্থী আন্দোলনের চাপে সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত, নির্দেশনা ও সুপারিশ আসে। অন্তত চারটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি-টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। প্রণয়ন করা হয় নতুন সড়ক পরিবহন আইন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এগুলোর বাস্তবায়ন খুব একটা হয়নি। সড়ক আইনটি তো এখন পর্যন্ত কার্যকরই করতে পারেনি সরকার।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এ পর্যন্ত যত সুপারিশ এসেছে, সবই বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি যানবাহনের ফিটনেস ও চালকের দক্ষতা বাড়াতে বিআরটিএ কাজ করছে। সড়ক পরিবহন আইন শিগগিরই কার্যকর হবে। আইনের প্রয়োগ শুরু হলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও এআরআইয়ের সাবেক পরিচালক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক নিরাপদ করার তিনটি ‘ই’ আছে। প্রথম হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং বা প্রকৌশলগত দিক। দ্বিতীয়ত, এনফোর্সমেন্ট বা আইনের প্রয়োগ। তৃতীয় হচ্ছে এডুকেশন বা জনসচেতনতা। সড়ক ও যানবাহনের প্রকৌশলগত দিক ঠিক নেই। এই অবস্থায় পোস্টার, প্রচারপত্র বিতরণ করে সচেতনতা কার্যক্রম কোনো কাজে আসবে না। চালককে দু-চার দিন প্রশিক্ষণ দিয়েও কাজ হবে না। কারণ, চালক একটানা চার ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাচ্ছে কি না, তা নজরদারি করার কোনো ব্যবস্থা নেই।

শুধু কমিটি আর সুপারিশ
গত ৫ সেপ্টেম্বর বিআরটিএ কার্যালয়ে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক হয়। সেখানে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটির করা ১১১ দফা সুপারিশ অনুমোদন করা হয়। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। কিন্তু টাস্কফোর্স গঠনের দেড় মাস পরও এর কোনো বৈঠক হয়নি।

সড়ক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, কমিটি গঠন আর সুপারিশ প্রণয়নে সাত মাস লেগেছে। এখন টাস্কফোর্স কাজ শুরু করতে কত দিন নেয়, এটাই দেখার বিষয়।

গত বছরের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পাঁচ দফা অনুশাসন দিয়েছিলেন। এর মধ্যে দূরপাল্লার চালকদের জন্য মহাসড়কের পাশে বিশ্রামাগার নির্মাণ, দূরের পথে বিকল্প চালক রাখা এবং একজন চালককে আট ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাতে না দেওয়া উল্লেখযোগ্য। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) মহাসড়কে চালকদের জন্য বিশ্রামাগার নির্মাণের একটি প্রকল্প নিয়েছে। এর বাইরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে গত বছরের জুলাই মাসে সড়ক মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি ৪৬টি সুপারিশ তৈরি করে। তবে এসব সুপারিশ কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে, এর আর কোনো পর্যালোচনা হয়নি। এরই মধ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণে সড়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুল মালেকের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি হয়। তারা ১২টি সুপারিশ করে। এর আগে ২০১৭ সালে এবং আরও আগে ২০১১ সালে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কমিটি করা হয়েছিল। এসব কমিটির প্রতিবেদনে এখন ধুলো জমেছে।