সুরক্ষা, প্রতিবাদ, ফ্যাশনে মাস্ক

সবার কাছে টিকা পৌঁছানোর আগে মাস্কই মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে। এই মাস্ককে দেখা যাচ্ছে ফ্যাশনের অনুষঙ্গ, প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবেও।

মাস্ক ব্যবহারের শুরুটা হয়েছিল প্রয়োজন থেকে। মাস্কের নকশা তখন মুখ্য বিষয় ছিল না। তবে এখন মাস্ক করোনা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার পাশাপাশি মানুষের সৌন্দর্য প্রকাশের মাধ্যমও হয়ে উঠছে। ধীরে ধীরে মাস্ক পরিণত হচ্ছে ফ্যাশনের অনুষঙ্গে। এ ছাড়া দেশে-বিদেশে প্রতিবাদী আন্দোলনেও মাস্কের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে।

গুণগত মানের পাশাপাশি অনেকে এখন মাস্কের নকশার দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন। সার্জিক্যাল মাস্কের পাশাপাশি কাপড়ের তৈরি মাস্ক জনপ্রিয় হয়েছে। কারণ, কাপড়ের মাস্ক ধুয়ে বারবার ব্যবহার করা যায়। তা ছাড়া এগুলোতে নানা রকম নকশাও ফুটিয়ে তোলা যায়।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এখন মানুষের মধ্যে আতঙ্ক–ভয় কাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে মাস্কে রংবেরঙের নকশার ব্যবহার কিছুটা বৈচিত্র্য আনছে জীবনে। দেশীয় প্রতিষ্ঠান মাস্ক ইউর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব আলম বললেন, মুখোশের আড়ালে যে মানুষ থাকেন, তাঁর আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা আছে। মাস্কের মাধ্যমে মানুষের রুচি ও অভিব্যক্তি বোঝা যায়। তাই ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যাবে এমন নকশা বেছে নিচ্ছেন অনেকে। চিত্রকর্ম ভালোবাসেন, এমন মানুষ সেই মাস্কগুলোই হয়তো কিনছেন, যেগুলোতে বিখ্যাত চিত্রকর্ম তুলে ধরা হয়েছে।

মুখোশের আড়ালে যে মানুষ থাকেন, তাঁর আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা আছে। মাস্কের মাধ্যমে মানুষের রুচি ও অভিব্যক্তি বোঝা যায়। তাই ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যাবে এমন নকশা বেছে নিচ্ছেন অনেকে।
মাহবুব আলম, মাস্ক ইউর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

মাস্কের শুরুটা যেভাবে

গবেষণাবিষয়ক ওয়েবসাইট দ্য কনভারসেশন ডট কমের তথ্য অনুযায়ী, পোল্যান্ডের ব্রেসলাউ (বর্তমানে রোকলা) বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি বিভাগের প্রধান জোহান মিকুলিক্জ একদিন কাজ করতে গিয়ে শ্বাসকষ্টকালীন হাঁচি–কাশিতে ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পান। এরপর, ১৮৯৭ সাল থেকে তিনি মুখে মাস্ক পরতে শুরু করেন। তাঁর মাস্ক ছিল আসলে দুটি দড়ির সঙ্গে বাঁধা গজ কাপড়ের একটি বড় টুকরো, যা পুরো মুখ ঢেকে রাখত।

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে মাস্ক ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে। রাসায়নিক দিয়ে জীবাণু মারার চেয়ে জীবাণুকে দূরে রাখার দিকেই মনোযোগ দেওয়া হয়।

১৯১০-১১ সালে মাঞ্চুরিয়ান প্লেগ মহামারির সময় মুখ ও নাক ঢাকতে মাস্কের ব্যবহার ছিল। ১৯৩০–এর দশকে মেডিকেল মাস্কের বদলে কাগজের তৈরি মাস্কগুলো জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ১৯৬০ সালের দিকে একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া যায় (ওয়ানটাইম ইউজ), এমন মাস্ক তৈরি করা শুরু হয় সিনথেটিক উপকরণ দিয়ে। ফিল্টার দেওয়া মাস্ক আসে আরও পরে।

পোল্যান্ডের ব্রেসলাউ (বর্তমানে রোকলা) বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি বিভাগের প্রধান জোহান মিকুলিক্জ একদিন কাজ করতে গিয়ে শ্বাসকষ্টকালীন হাঁচি–কাশিতে ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পান। এরপর, ১৮৯৭ সাল থেকে তিনি মুখে মাস্ক পরতে শুরু করেন।

মাস্ক পরার গুরুত্ব বোঝাতে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ নিতে হয়েছে কখনো কখনো। উত্তর আমেরিকায়, ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির সময় শহরগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরার আদেশ দিতে হয়েছিল। এতে সুফলও আসে। সান ফ্রান্সিসকোর মতো জনবহুল শহরে মৃত্যুর হার কমে এসেছিল।

জাপানে স্প্যানিশ ফ্লুর সময় মাস্ককে ভালোভাবে গ্রহণ করেছিল মানুষ। ১৯৭০ সালের দিকে যখন এর টিকা সবার জন্য সুলভ হয়, তখন মাস্ক পরা বন্ধ হয়। ১৯৮০ ও ১৯৯০ দশকে অ্যালার্জি প্রতিরোধের জন্য মাস্ক পরার চল ছিল।

চিনেও মাস্ক পরার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ১৯১০-১৯১১ সালে নিউমোনিক প্লেগ মহামারির সময় ব্যাপকভাবে মাস্ক পরা হতো। ১৯৪৯ সালে বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসার পর, যুদ্ধ–পরবর্তী জীবাণু সংক্রমণের ভয় থেকে অনেকে মাস্ক পরতেন।

কোভিড-১৯ মহামারিকালে মাস্ককে টিকার সমান গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সবার কাছে টিকা পৌঁছানোর আগপর্যন্ত এই মাস্কই মানুষের জীবন বাঁচাবে।

মাস্ক পরার গুরুত্ব বোঝাতে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ নিতে হয়েছে কখনো কখনো।

দেশি মাস্কে সুন্দর নকশা

দেশের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসের পাশাপাশি কিছু প্রতিষ্ঠান শুধু মাস্কই তৈরি করছে। গত আগস্ট থেকে দেশি মাস্ক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মাস্ক ইউ মাস্ক বিক্রি করা শুরু করেছে। চলতি মাসের ২৩ তারিখ পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ৬৫ হাজার মাস্ক। প্রতিদিন ৯০০ থেকে ১ হাজারের মতো মাস্ক কিনছেন ক্রেতারা।

ফ্যাশন হাউস সারা লাইফস্টাইলের কাছ থেকেও একই রকম তথ্য পাওয়া গেল। তাদেরও প্রতিদিন ৯০০ থেকে ১ হাজার মাস্ক বিক্রি হচ্ছে। মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান থেকে দুই লাখের ওপর মাস্ক কিনেছেন ক্রেতারা। ফ্যাশন হাউস লা রিভও গত ২০ মে থেকে মাস্ক বিক্রি করা শুরু করেছে। এ পর্যন্ত মোট উৎপাদনের ৮০ শতাংশ মাস্ক বিক্রি করে ফেলেছে প্রতিষ্ঠানটি।

দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো থেকে বানানো অথবা বাইরের দেশগুলো থেকে আমদানি করা মাস্কগুলোর দামের পার্থক্য থাকে মাস্কের গুণমান ও উপাদানের ওপর ভিত্তি করে। তবে ১৫০ থেকে ১ হাজার টাকার ভেতরে কেনা যায় একেকটি মাস্ক।

দেশের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসের পাশাপাশি কিছু প্রতিষ্ঠান শুধু মাস্কই তৈরি করছে।

দেশের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস মাস্কের সুন্দর সুন্দর নকশা করছে। দেশীয় সাংস্কৃতিক নকশার মাস্ক এখন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এর মধ্যে আছে পতাকার নকশায় মাস্ক, গামছা, জামদানির কাপড়ে তৈরি মাস্ক। আরও আছে রিকশাচিত্র, প্রাকৃতিক রং, মোম বাটিকে নকশা করা মাস্ক। মাস্কের মূল ব্যবহার যে জন্য, সেদিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে।

ফ্যাশন হাউস কিউরিয়াসের বিপণন নির্বাহী তাসনুভা আহমেদ বলেন, মাস্কের ওপর ছাপার ব্যবহার অনেকেই পছন্দ করছেন। স্কার্ফ, ব্যান্ড ইত্যাদি বিভিন্ন গঠন ও আকারে মাস্ক আসছে। অনেক মাস্কে তো এলইডি বাতিও লাগানো হয়েছে। চীন থেকে আমদানি করা এ ধরনের মাস্ক তিনি কিনেছেন উপহার হিসেবে দিতে।

নজর কাড়ছে বিদেশি মাস্কও

বিদেশি কিছু মাস্কের নকশা অনেকের নজর কাড়ছে। স্বচ্ছ মাস্কের কথাই ধরা যাক। সাধারণ মাস্ক পরলে কেউ কেউ একে অন্যকে চিনতে পারেন না। এমনকি পাশাপাশি দাঁড়িয়েও চেনা যায় না। কারণ, মুখ তো মুখোশে ঢাকা। স্বচ্ছ মাস্কের মজাটা হলো, চেহারা দেখা যাবে, আবার সুরক্ষাও পাওয়া যাবে।

এসব মাস্কের আবার বাহারি নাম—স্মাইল মাস্ক, ক্লিয়ার উইন্ডো ফেস মাস্ক, নো ফগ ফেস মাস্ক, কমিউনিকেশন মাস্ক। ক্লিয়ার বা স্বচ্ছ মাস্ক তৈরি হয়েছে শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের সহায়তা করার জন্য। সাধারণ বা বিশেষ শিশুদের সঙ্গে কথা বলার জন্য এটি বেশ সহায়ক। চেহারা কিংবা চেহারার সাজ দেখানোর জন্যও এটি জনপ্রিয়। স্বচ্ছ এই মাস্কগুলো যুক্তরাষ্ট্রে ক্লিয়ার মাস্ক এবং কানাডায় মিনগেল মাস্ক নামে পরিচিত। দুই দেশের এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠানের নামেই মাস্কগুলো বাজারজাত করছে। ইতালির দিয়েনপি নামক ফ্যাশন প্রতিষ্ঠানও এ ধরনের মাস্ক তৈরি করছে।

ক্লিয়ার মাস্কের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, দেখা থেকে ৫৫ শতাংশ যোগাযোগ হয়। সনাতনি মাস্ক চেহারার অভিব্যক্তি ঢেকে রাখে। স্বচ্ছ মাস্কে সে বাধা নেই। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) অনুমোদন পেয়েছে এটি।

পাশ্চাত্যের নামী-দামি ব্র্যান্ডগুলোকে আগামী এক-দুই বছর হয়তো মাস্ক বিক্রি করেই উপার্জন বাড়াতে হবে। পুরুষদের দামি পোশাক তৈরির প্রতিষ্ঠান বিজান মুখের সুরক্ষাকবচ বানাচ্ছে। সিল্ক কাপড়ে তৈরি মাস্কগুলোর দাম ৪০০ মার্কিন ডলারের বেশি। ডিওর, ফেনডি, লুই ভিতুঁ, বারবেরি, গিভেনচির মতো ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো ক্রেতাদের জন্য বিভিন্ন নকশার দামি মাস্ক বিক্রি করছে। এসব প্রতিষ্ঠান আবার সার্জিক্যাল মাস্ক তৈরি করে বিভিন্ন হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানে বিনা মূল্যে বিলি করেছে।

মাস্কের ওপর ছাপার ব্যবহার অনেকেই পছন্দ করছেন। স্কার্ফ, ব্যান্ড ইত্যাদি বিভিন্ন গঠন ও আকারে মাস্ক আসছে। অনেক মাস্কে তো এলইডি বাতিও লাগানো হয়েছে। চীন থেকে আমদানি করা এ ধরনের মাস্ক তিনি কিনেছেন উপহার হিসেবে দিতে।
বিপণন নির্বাহী তাসনুভা আহমেদ, ফ্যাশন হাউস কিউরিয়াস

মাস্কের গুণগত মান ও নকশা পছন্দ হলে পরার আগ্রহ বেড়ে যায় অনেকটা। ত্রিমাত্রিক (থ্রিডি) নকশার মাস্ক এ ক্ষেত্রে অন্যতম। গঠন ও নকশা—দুই দিক থেকেই ক্রেতাদের মুগ্ধ করছে এটি। আবার জিব বের করা অদ্ভুত নকশার মাস্কও নজর কাড়ছে। ক্রেতারা কিনছেন, পরছেন, অন্যদের প্রতিক্রিয়া দেখে মজা পাচ্ছেন।

প্রতিবাদেও মাস্ক

একদিকে ফ্যাশনপ্রেমীরা পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে মাস্ক পরছেন, আরেক দিকে ধর্ষণসহ বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে মুখের মাস্কে। সারা দেশে ধর্ষণ ও নিপীড়নের ঘটনায় বিচারের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। অক্টোবর মাসে করোনার মধ্যেই বিক্ষোভ করেছেন তাঁরা। তবে তাঁদের মুখে ছিল মাস্ক। আর অনেকের মাস্কের ওপর লেখা ছিল ‘স্টপ রেপ’।

বিদেশেও মাস্ক দিয়ে প্রতিবাদের ঘটনা আছে। এ বছরই মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় জর্জ ফ্লয়েড পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান। এরপর জুন থেকে শুরু হয় ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অন্যতম বড় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন ছিল এটি। সেখানেও বিক্ষোভকারীদের মুখের মাস্কে লেখা ছিল ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’, ‘আই কান্ট ব্রিথ’ প্রতিবাদী কথাগুলো।

প্রিন্ট, হাতের নকশা—সবকিছুই তুলে ধরা হচ্ছে মাস্কের ওপর। বিয়ের কনেদের জন্য এসেছে পুঁতি বসানো বা বেনারসির নকশায় জমকালো মাস্ক। হিরে বসানো মাস্ক প্রায় প্রথম থেকে আলোচনায় ছিল। ক্রেতাদের উৎফুল্ল রাখার জন্য জাপানের কক্স কো’স মাস্ক ডট কম হিরে বসানো মাস্ক বিক্রি করছে। প্রতিটি মাস্কের দাম পড়বে ৬ হাজার ৯০০ ডলার (প্রায় ৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা)। ভারতের সুরাটেও হীরা বসানো মাস্ক কিনতে পারবেন ক্রেতারা। দাম ১ থেকে ৪ লাখ টাকা।

করোনাকালে চেষ্টা চলছে সব দেশেই মাস্কে নতুন কিছু আনার, ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার। উদ্দেশ্য সবাই যেন মাস্ক পরতে আগ্রহ পায়। করোনাভাইরাসের টিকা বাজারে চলে এসেছে ঠিকই, কিন্তু আগামী বছরটাও সম্ভবত অনেককে মাস্ক পরে কাটাতে হবে, নিজের এবং প্রিয়জনের সুরক্ষার জন্য।