সুরক্ষার চেয়ে জনশক্তি রপ্তানি বাড়ানোতেই বেশি মনোযোগ

চলতি বছর মোট ৯ লাখ ৭৩ হাজার বাংলাদেশি কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ছবি: এএফপি
চলতি বছর মোট ৯ লাখ ৭৩ হাজার বাংলাদেশি কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ছবি: এএফপি

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গিয়ে নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের শ্রমিকেরা। তাঁদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার চেয়ে বিদেশে বিপুল জনশক্তি রপ্তানির পরিধি বাড়ানোই সরকারের প্রধান লক্ষ্য। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, কর্মীদের অভিবাসন খরচ না কমার কারণে বিদেশে গিয়েও তাঁরা মানসিক চাপে ভোগেন। এ কারণে তাঁরা কর্মস্থলে ঝুঁকিতে থাকেন।

এই প্রেক্ষাপটে দেশে আজ সোমবার পালিত হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবস। গতকাল রোববার প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বলেন, এ বছর মোট ৯ লাখ ৭৩ হাজার বাংলাদেশি কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এর মধ্যে মহিলা কর্মী ১ লাখ ১৮ হাজার। এটি এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যা। এ ছাড়া শিগগিরই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদের জাপানে পাঠানো হবে।

তবে সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানোর সংখ্যা বাড়লেও তাঁদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠছে। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, এ মুহূর্তে নির্যাতিত হয়ে তিন শর মতো নারী শ্রমিক দূতাবাস পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। এ ছাড়া দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছেন ৫০ জনের বেশি।

জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা জানান, সৌদি আরবে যাওয়ার কিছুদিন পর নারী শ্রমিকদের পরিবারের পক্ষ থেকে নানা রকম নির্যাতনের অভিযোগ তোলা হচ্ছে। নানা রকম শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি সময়মতো বেতন না পাওয়া, অতিরিক্ত সময় কাজ করানো এবং কখনো কখনো বেতন না পাওয়ার অভিযোগ তাঁরা তুলেছেন।

রিয়াদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, অতিরিক্ত কাজের চাপ, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেতন ও কাজ না পাওয়া, দুর্ব্যবহার বা নির্যাতনের কারণে গৃহকর্তার বাড়ি থেকে পালিয়ে দূতাবাসের সেফ হোমে চলে আসেন নারী গৃহকর্মীরা।

বিদেশে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল নুরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রবাসী নারীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। চলতি বছর বিভিন্ন দেশে নয়জন প্রবাসী নারীর এ রকম অভিযোগ পাওয়া গেছে। আমরা এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান করেছি।’

আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবস উপলক্ষে গতকাল প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী তাঁর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জনশক্তি রপ্তানি স্বাধীনতার পর থেকে সর্বোচ্চ, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার বেশি। বরাবরের মতো এবারও বেশির ভাগ কর্মী গেছেন সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ওমান ও কাতারে। এর অর্ধেকের বেশি (৫ লাখ ১৩ হাজার ৮৬২) কর্মী গেছেন সৌদি আরবে। গত বছর দেশটিতে গিয়েছিলেন ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯১৩ জন।

প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী গতকালের ব্রিফিংয়ে জানান, জাপান বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নিয়োগের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করার পর এ ব্যাপারে কিছুদিনের মধ্যে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হবে। মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব ভবনে গতকাল একটি স্থায়ী জাপানি ভাষা প্রশিক্ষণকেন্দ্রের উদ্বোধন করা হয়।

এ বছর ১০ লাখের বেশি কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান হবে বলে আশা প্রকাশ করে নুরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে।

প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী জানান, বিদেশে কর্মী পাঠানোর লক্ষ্যে সারা দেশে পিছিয়ে পড়া ৪২টি জেলার ২২টি থেকে লোক বাছাই করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। অচিরেই অভিবাসনে পিছিয়ে পড়া বাকি ২০টি জেলার প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য প্রশিক্ষণ শুরু হবে।

জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষায় যুক্ত গবেষণা সংস্থা রামরুর সমন্বয়ক সি আর আবরার গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে অর্থ ব্যয় করে অভিবাসী কর্মীরা যাচ্ছেন, অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় তা অনেক বেশি। অনেক বৈরী পরিবেশে ও শর্তে তাঁরা কাজে যাচ্ছেন। অভিবাসন ব্যয় কমানোয় কার্যকর পদক্ষেপ নেই। বিভিন্ন দেশে আমাদের কর্মীরা যে হারে মারা যাচ্ছেন, তার বড় কারণ হচ্ছে মানসিক চাপ। কারণ, ঋণ নিয়ে যে স্বপ্ন পূরণের আশায় দেশের বাইরে তাঁরা পা রাখছেন, বিদেশে গিয়ে তাঁদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হচ্ছে।’