সুরতহাল প্রতিবেদনে মনগড়া তথ্য

গুলিতে নিহত স্বামী আজাদের মরদেহের সামনে গতকাল কান্নায় ভেঙে পড়েন সুলতানা বেগম৷ ছবিটি গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ থেকে তোলা l প্রথম আলো
গুলিতে নিহত স্বামী আজাদের মরদেহের সামনে গতকাল কান্নায় ভেঙে পড়েন সুলতানা বেগম৷ ছবিটি গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ থেকে তোলা l প্রথম আলো

রাজধানীর পল্লবীর কুর্মিটোলা বিহাির ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ ও গুলিতে নিহত ১০ জনের মধ্যে পাঁচজনের সুরতহাল প্রতিবেদনে মনগড়া তথ্য জুড়ে দিয়েছে পুলিশ৷ এতে আততায়ীর গুলিতে নিহত, বিহারি-বিহারি ও বিহারি-বাঙালি ত্রিমুখী সংঘর্ষের মতো অপ্রাসঙ্গিক তথ্য এসেছে৷
কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু বা কেউ নিহত হলে ফৌজদারি আইন অনুসারে ময়নাতদন্তের আগে মৃত ব্যক্তির শরীরে ক্ষত, ভাঙা বা মচকানোর দাগ, আঁচড়ের দাগ, অন্যান্য আঘাতের চিহ্ন উল্লেখ করে পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেট সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন৷ এই প্রতিবেদন মামলায় সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷
গতকাল রোববার দুপুরে নিহত ১০ জনের সুরতহাল প্রতিবেদন ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানোর পর শুরু হয় ময়নাতদন্ত৷ পল্লবী থানার চারজন উপপরিদর্শক (এসআই) সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন৷ এর মধ্যে পাঁচটি প্রতিবেদন নিয়ে প্রথম আলোর কাছে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান নিহত ব্যক্তিদের কয়েকজন স্বজন৷ তাঁদের একজন মো. মিন্টু মর্গ প্রাঙ্গণে বলেন, ‘সুরতহালে পুলিশ যা লিখছে সব মিথ্যা৷’
গত শনিবার ভোরে বিহাির ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে আশপাশের লোকজন ও পুলিশের সংঘর্ষ হয়৷ বিহারিদের অভিযোগ, পুলিশের সঙ্গে বহিরাগতরাও হামলা চালায় এবং ঘরে তালা দিয়ে আগুন দেয়৷ এতে বেবী, তাঁর মেয়ে শাহানা, আফসানা ও রুকসানা এবং ছেলে আশিক, ভুলু ও লালু, শাহানার শিশুসন্তান মারুফ এবং আশিকের স্ত্রী শিখার মৃত্যু হয়৷ এ ছাড়া গুলিতে নিহত হন আজাদ নামের আরেকজন৷
আজাদ ও আশিকের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন এসআই মোশাররফ হোসেন৷ আজাদের সুরতহাল প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, ‘প্রাথমিকভাবে জানা যায়, পল্লবী থানাধীন বিহারি ক্যাম্পে আতশবািজ ফোটানোকে কেন্দ্র করে বিহারি-বিহাির ও বিহারি-বাঙালি বিরোধের
জের ধরে সংঘর্ষ চলাকালীন আততায়ীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ওই আজাদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়৷’ আশিকের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ‘তদন্তকালে ও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আতশবাজি এবং বিভিন্ন পটকা ফোটানোকে কেন্দ্র করে বিহাির-বিহারি এবং বিহারি-বাঙালি গ্রুপের ত্রিমুখী সংঘর্ষকালীন নিজগৃহে অগ্ন্যুৎপাত ঘটিলে বা অগ্নিসংযোগের ফলে উক্ত মৃত অগ্নিদগ্ধ হয়।’
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে এসআই মোশাররফ বলেন, ‘আততায়ী বলতে বুঝিয়েছি অজ্ঞাতনামা৷’ সুরতহালে এসব লেখার আইন আছে কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি তো তদন্ত করিনি, সুরতহাল করেছি৷’ তাহলে সুরতহালে ‘তদন্তকালে’ কেন লেখা? এর কোনো সুস্পষ্ট উত্তর দেননি তিনি৷
অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত লালু, রুকসানা, মারুফের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন এসআই কামরুল ইসলাম৷ এই তিনজনের প্রতিবেদনেও তিনি এসআই মোশাররফের করা আশিকের প্রতিবেদনে উল্লিখিত বাক্যটি হুবহু তুলে দিয়েছেন৷ তদন্তাধীন বিষয়ে সুরতহালে এমন মন্তব্য করা ঠিক কি না জানতে চাইলে এসআই কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আপনার কথা ঠিক আছে৷ তবে আমি একটু ব্রডলি করেছি৷’
তবে নিহত বেবী, ভুলু, শাহানা, আফসানা ও শিখার সুরতহাল প্রতিবেদন ভিন্ন৷ বেবী, শিখা ও ভুলুর প্রতিবেদন তৈরি করেছেন এসআই মহেশ চন্দ্র সিংহ৷ আফসানা ও শাহানার প্রতিবেদন তৈরি করেছেন এসআই এনামুল হক৷ প্রত্যেকের প্রতিবেদনে শুধু ‘আগুনে পুড়ে মৃত্যু’র কথা লেখা হয়েছে৷
অন্য প্রতিবেদন সম্পর্কে প্রশ্ন করলে উপপরিদর্শক (এসআই) এনামুল হক বলেন, ‘অন্যরা কী লিখেছে আমি জানি
না৷ কে কীভাবে মারা গেল, সংঘর্ষে মারা গেল কি না তা দেখার দায়িত্ব তদন্তকারী কর্মকর্তার৷ এ ধরনের কথা সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত কর্মকর্তা বলতে পারেন না৷’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকে বুঝে না-বুঝে সুরতহাল লিখছেন৷ ভুল যে হচ্ছে না তা অস্বীকার করব না৷ তবে সুরতহালের নিয়ম হচ্ছে, আমি চোখের সামনে লাশ যেভাবে দেখছি তার বর্ণনা দেওয়া৷ এর বেশি কিছু অনুমান কিংবা ধারণা করে লেখা মোটেই ঠিক নয়৷’