সুশাসনের ঘাটতিতে পরিস্থিতি প্রকট

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া গেলেও সরকারের নেওয়া কার্যক্রমে সুশাসনের ব্যাপক ঘাটতি দেখা গেছে বলে এক গবেষণায় উল্লেখ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে, সরকারের নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রমে পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের ঘাটতি এবং বিভ্রান্তিকর ও পরস্পরবিরোধী নানা কর্মকাণ্ডের কারণে দেশে করোনা পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া দীর্ঘদিনের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা, সুশাসনের ঘাটতি ও অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দের কারণে স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা আরও গভীরভাবে ফুটে উঠেছে।

‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে।। এতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে ৫৩ শতাংশ হাসপাতালের সাধারণ চিকিৎসাসেবায় ব্যাঘাত ঘটছে। এ ছাড়া ৭১ শতাংশ হাসপাতালে নিম্নমানের সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) সরবরাহের কারণে অনেক স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হচ্ছেন বা সেবা দেওয়া থেকে বিরত থাকছেন।

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের ১০০তম দিনে গতকাল সোমবার ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, গত রোববার পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ২৩ লাখ পিপিই বিতরণ করা হয়েছে। সেই হিসাবে কর্মরত ৭৫ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীর প্রত্যেকে অন্তত ৩০ সেট পিপিই পাওয়ার কথা। কিন্তু অনেক স্বাস্থ্যকর্মী একটিও পিপিই পাননি।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়ের ঘাটতি ও দুর্নীতি অব্যাহত থাকার কারণে করোনায় আক্রান্তের বাইরে সাধারণ রোগীরাও স্বাস্থ্যসেবা থেকে প্রায় বঞ্চিত অবস্থায় রয়েছেন। এ ছাড়া জীবন ও জীবিকার দ্বন্দ্বে শুরু থেকেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার বিষয়টিকে যৌক্তিকভাবে প্রাধান্য দেওয়া হলেও সেখানে পর্যাপ্ত পরিকল্পনা ছিল না। গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা মোকাবিলায় গৃহীত নানা পদক্ষেপে সুশাসনের ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি ছিল, দুর্নীতি হয়েছে উদ্বেগজনকভাবে।

করোনা মোকাবিলায় প্রাক্‌সংক্রমণ প্রস্তুতিমূলক পর্যায়ে এবং সংক্রমণকালে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে গত ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষণাটি করা হয়। গবেষণার জন্য ৩৮টি জেলার ৪৭টি হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মনজুর-ই-খোদা এবং ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. জুলকারনাইন। সঞ্চালনা করেন সংস্থার আউটরিচ ও কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মঞ্জুর-ই-আলম। উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের।

>করোনা মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপে সুশাসনের ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি ছিল, দুর্নীতি হয়েছে উদ্বেগজনকভাবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হাসপাতালগুলোর মধ্যে প্রায় ৫৭ শতাংশ হাসপাতাল চাহিদার তুলনায় কম পরীক্ষা (করোনা শনাক্ত) করাতে পারছে। পরীক্ষার ফল পেতে দুই থেকে আট দিন পর্যন্ত লাগছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জনসংখ্যা অনুপাতে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন (মাত্র ০.২৯%) পরীক্ষা হচ্ছে। পরীক্ষার হারের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯তম।

গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০টি পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত প্রায় ৮৫টি পিসিআর মেশিনে দিনে তিন পালায় প্রায় ২৪ হাজার পরীক্ষার সক্ষমতা থাকলেও মেডিকেল টেকনোলজিস্ট-সংকট, মেশিন নষ্ট থাকা, জনবল সংক্রমিত হওয়া ও সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে সবশেষ ১৪ দিনে গড়ে ১৩ হাজার ৬০০ করে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জনবল ও যন্ত্রপাতির সক্ষমতা থাকলেও তার পূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে না। এন-৯৫ মাস্ক ক্রয়ে দুর্নীতি, নিম্নমানের পিসিআর মেশিন ক্রয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে দায়ী ও জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় এনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। উল্টো সরবরাহ করা মাস্ক ও পিপিইর মান নিয়ে প্রশ্ন তোলায় চারজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তথ্য প্রকাশে বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে আড়াল করা হচ্ছে।

সরকারের ত্রাণ কার্যক্রম সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গবেষণাভুক্ত এলাকার ৮২ শতাংশ স্থানে সুবিধাভোগীর তালিকা প্রণয়নে রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রায় ৪২ ভাগ এলাকার ক্ষেত্রে ত্রাণ বিতরণে কোনো তালিকা অনুসরণ না করার অভিযোগ রয়েছে। ত্রাণ বিতরণে চুরি ও আত্মসাতের সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশে গণমাধ্যমকর্মীদের বাধা, হয়রানি ও নির্যাতনের ঘটনা দেখা গেছে। সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৬৭টি মামলা এবং ৩৭ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

করোনা সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে টিআইবি ১৫ দফা সুপারিশ উত্থাপন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের বিদ্যমান যন্ত্রপাতি ও জনবলের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষার সুবিধা জেলা পর্যায়ে আরও সম্প্রসারণ করা। বিদ্যমান সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য খাতে জেলা পর্যায়ে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো (জিডিপির ৫%)। স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পিপিই সরবরাহ নিশ্চিত করা, সব হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার পাশাপাশি অন্যান্য রোগের নিয়মিত চিকিৎসা নিশ্চিত করা, ত্রাণ ও সামাজিক সুরক্ষার উপকারভোগীদের তালিকা হালনাগাদ করে ওয়েবসাইটে প্রকাশ এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের স্বার্থে গণমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে করা। ত্রাণ দুর্নীতিতে জড়িত সাময়িক বরখাস্ত জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা অন্যতম।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোনো ম্যাজিক বুলেটের প্রয়োজন নেই। যাঁরা দুর্নীতি করেন, তাঁরা কর্তৃপক্ষের জানাশোনার বাইরে নন। তিনি সংকট মোকাবিলায় তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় গুরুত্ব আরোপ করেন।