সুস্থ ফাতেমা বৈরুত থেকে পঙ্গু হয়ে ফিরলেন

ফাতেমা বেগম পরিবারের বাধা উপেক্ষা করে একাই দৃপ্ত পায়ে হেঁটে বিমানে উঠেছিলেন। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তাঁর গন্তব্য লেবাননের বৈরুত। তারিখটা ছিল ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি। তিন মাসের মাথায় দেশে ফিরেছেন। এখন ওয়াকার ছাড়া হাঁটতে পারেন না। পঙ্গু হয়ে গেছেন তিনি। কারণ গৃহকর্ত্রী খেপে গিয়ে তাঁকে তিনতলা থেকে ফেলে দিয়েছিলেন। 

গত বৃহস্পতিবার ফাতেমা এসেছিলেন প্রথম আলো কার্যালয়ে। ঘুরেফিরে বারবার একটা কথাই বলেছেন, ‘শুধু হাত-পাও নিয়া ফিরতে পারতাম। তাহলেও জীবনটা এমন হইত না। মেরুদণ্ডের হাড় ভাঙা। বাম পা সোজা করতে পারি না। হাতের ভেতর স্টিলের পাত। হাতটা মুঠ করতে পারি না।’ ফাতেমা হাত দিয়ে চোখ মোছেন। কনুইয়ের কাছের আঘাতটা থেকে তখনো পুঁজ বেরোচ্ছে। অপ্রস্তুত ফাতেমা বললেন, সারাক্ষণ পুঁজ পড়ে। পুঁজ না শুধু, মেরুদণ্ডের হাড় ভাঙায় বাথরুমের ওপর আর নিয়ন্ত্রণ নেই। যারা একসময় ভালোবাসত, তারা এখন ঘেন্না করে।
মিরপুরের মণিপুরিপাড়ায় ফাতেমা থাকতেন স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে। স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। আর তিনি বাসায় বাসায় ঠিকা কাজ করতেন। কায়-ক্লেশে জীবন কাটলেও অশান্তি ছিল না। ২০১৬ সালের শেষ দিকে তিনি ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছিলেন বরিশালের উজিরপুরে, গ্রামের বাড়িতে। সেখান থেকে এক খালার বাসায়। মেরিনা বেগম নামে এক নারী তাঁকে বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দেন। খুব অল্প দিনের মধ্যেই মেরিনার স্বামীর সহযোগিতায় ফাতেমা পাসপোর্ট-ভিসা করে লেবাননে যাওয়ার আয়োজন চূড়ান্ত করে ফেলেন। স্বামী রাজি ছিলেন না, ভাইও না। ভাই তো রাগ করে বলেই বসেছিলেন, বোনের ভালো-মন্দ কোনো কিছুতে তিনি আর নেই। তবু ফাতেমা অনড়।
২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি ফাতেমা লেবাননে পৌঁছান। বিমানবন্দরে তাঁকে নিতে আসেন তাঁর নিয়োগকর্তা। ফাতেমা হাতে থাকা কাগজের সঙ্গে নিয়োগকর্তার ছবি মেলান। মিলে গেছে। খুশি মনে বিমানবন্দর ছাড়েন তিনি। কিন্তু ওই ব্যক্তি তাঁকে আর বাসায় নেননি। রেখেছিলেন মেরিনার কাছে। চার-পাঁচ দিনে কী কী কাজ করতে হবে জানার পর তাঁর নিয়োগকর্তা তাঁকে দিয়ে আসেন আরেক বাসায়। ওই নিয়োগকর্তার নাম মিস্টার ফদর। ফাতেমা মালিক পরিবর্তনের কারণ জানতে চান মেরিনার কাছে। মেরিনা আশ্বস্ত করেন।
ফাতেমা বলছিলেন, পরিবারটি খুব একটা বড় ছিল না। স্বামী-স্ত্রী আর তাঁদের তিন সন্তান। ঘরে আরেকজন গৃহকর্মী ছিলেন। তাঁর কাজ ছিল শুধু ওই শিশুদের সঙ্গে খেলা। আর ওই বাড়িতে তাঁর প্রথম কাজ ছিল এক ঝুড়ি কাপড় ইস্তিরি করা। রান্না ছাড়া ঘরের সব কাজই তাঁকে করতে হতো। ফাতেমা কর্মঠ। কাজ দেখে ভয় পাননি। তবে প্রথমেই ধাক্কা খান খাবারের পরিমাণ দেখে। ওই বাড়িতে সকালে তাঁকে কিছু খেতে দেওয়া হতো না। দুপুরে এক টুকরো রুটি আর এক কাপ চা, রাতে কখনো রুটি, কখনো পরিজ আবার কখনো শুকনো বিস্কুট। ফাতেমা পেরে উঠছিলেন না।
খাওয়ার কষ্টের সঙ্গে সঙ্গে দিন সাতেকের মধ্যে শুরু হয় গৃহকর্ত্রীর নির্যাতন। গৃহকর্ত্রীর কাজ থেকে বাড়ি ফেরার সময় হলে শিশুরাই ফাতেমাকে সতর্ক করত। বলত, ‘মা আসছে। এখনই মারবে।’ কখনো কখনো তারাই এসে জড়িয়ে ধরে রক্ষা করেছে ফাতেমাকে। ঠিক কোন পর্যায়ে গিয়ে ফাতেমাকে তিন তলা থেকে ফেলে দিলেন গৃহকর্ত্রী? ফাতেমা বলছিলেন তিনি তিন মাসে একবারও বাড়িতে ফোন করার সুযোগ পাননি। তবে তাঁর বড় ভাইবোনের খোঁজখবর না পেয়ে মেরিনার স্বামীর থেকে মেরিনার ফোন নম্বর নেন। তাঁর কাছ থেকে বোনের বাসার নম্বর নিয়ে ফোন করেন। তাঁকে ফোনের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেওয়া না হলেও যেদিন তাঁর ভাই ফোন করেন সেদিন ফোনটি তিনিই তোলেন। বাড়িতে আর কেউ ছিল না। সবকিছু খুলে বলেন তিনি। একদিন মেরিনাকেও বাড়িতে ডাকিয়ে আনেন। সাফ জানিয়ে দেন তিনি দেশে চলে যাবেন। কিছুতেই আর ওই বাড়িতে কাজ করবেন না।
মেরিনা তাঁর গৃহকর্ত্রীকে এ কথা জানানোর পর অত্যাচার আরও বাড়ে। তিনি ফাতেমাকে অন্য কোথাও বিক্রি করে দেওয়ার হুমকি দেন। ফাতেমা কী করবেন ভেবে পান না। এর মধ্যে গত বছরের ১২ মার্চ গৃহকর্ত্রী ফাতেমাকে বলেন, ঘরের অন্য কাজ বাদ রেখে জানালা পরিষ্কার করতে। ফাতেমা যখন জানালা পরিষ্কার করছেন তখনই পেছন থেকে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেন তিনি। এরপর ফাতেমা নিজেকে উদ্ধার করেন হাসপাতালের বিছানায়। কে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল তিনি মনে করতে পারেন না। লাইফসাপোর্ট ছাড়াই যখন ফাতেমা কিছুটা সুস্থ বোধ করছেন তখন পুলিশ আসে। ফাতেমাকে নিয়ে গিয়েছিল যে নারী সে গৃহকর্ত্রীর পক্ষ হয়ে পুলিশকে বোঝায় ফাতেমা জানালা দিয়ে দড়িতে ঝুলে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। ভাষা না জানায় কোনো প্রতিবাদ করতে পারেননি ফাতেমা।
এদিকে ভাই কিন্তু ঠিকই বোনের সঙ্গে কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে আছেন। তিনি মেরিনাকে বাংলাদেশ থেকে বারবার ফোন করেন, কিন্তু বোনের ব্যাপারে মেরিনা আর কোনো কথা বলেন না। শেষ পর্যন্ত ভাই মেরিনার স্বামীর নামে আদালতে মামলা করে দেন। পুলিশ ধরে নিয়ে যায় মেরিনার স্বামীকে। মেরিনাও কথা বলিয়ে দেন বোনের সঙ্গে। এরপর ভাইয়ের চেষ্টায় ফাতেমা দেশে আসেন।
বিমানবন্দর থেকে সোজা তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে সিআরপিতে। এখনো চলছে চিকিৎসা। অর্থাভাবে নিয়মিত চিকিৎসা করাতে পারেন না। এক গ্লাস পানি ঢেলে খাওয়ার ক্ষমতাও নেই।
ফাতেমা বলছিলেন, স্বামী সেই রাজমিস্ত্রির কাজই করছেন। মাঝখান থেকে তাঁর আয় বন্ধ। একটা ওষুধের দাম ৪০ টাকা। তাঁর খরচ মেটাতে মেয়েটিকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এমব্রয়ডারির কারখানায় দিয়েছেন। অপরাধবোধে ভোগেন। দিনকে দিন আরও বেশি অচল হয়ে পড়ছেন। গ্রামের বাড়িতে যেতে পারেন না, লোকে ঠাট্টা করে। বলে, সবার কথা না শুনে বিদেশে যাওয়ায় উচিত শিক্ষা হয়েছে। আর ঢাকায় স্বামীর আয়ে এতগুলো পেট চলে না। কী যে করবেন তিনি বুঝে উঠতে পারেন না।
ফাতেমার কাছে প্রশ্ন ছিল, তিনি কী চান? উত্তরে বললেন, তাঁর চিকিৎসা প্রয়োজন। তিনি সুস্থ হয়ে কাজ করে খেতে চান। আর চান যাঁরা তাঁকে তিন তলা থেকে ফেলে দিয়েছিল তাদের বিচার। ফাতেমার ব্যাপারে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বাংলাদেশ দূতাবাসে চিঠি দিয়েছে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়েও চিঠি দিয়েছে। আসকের তদন্ত ইউনিটের সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির জানিয়েছেন, বাংলাদেশ দূতাবাস বিচার ও ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা করছে। শিগগির হয়তো কিছু জানা যাবে।