সেই বজ্রকণ্ঠে আহ্বান চাই

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে ফিরে এল ২৫ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৪ সালের এই দিনে পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোর প্রধান মঞ্চ জাতিসংঘে সর্বপ্রথম বাংলায় বক্তৃতা করলেন তিনি। অঙ্গীকার জানালেন গণতন্ত্র, ন্যায়, স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের প্রতি। তিন বছর আগে তাঁরই নেতৃত্বে বাংলাভাষীদের জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুর সেসব অঙ্গীকারের দিকে ফিরে তাকানোর দিন আজ।

১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে স্বাধীনতার বীজ বপন হয়েছিল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতির দাবিতে সূচিত ভাষা আন্দোলনের সময়। ১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধু মুক্ত অবস্থায় এতে অংশ নিলেও বায়ান্নতে তিনি বন্দী। কারাবন্দী বঙ্গবন্ধু অসুস্থ রাজবন্দী হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তখন মুক্ত নেতারা তাঁর কাছেই বুদ্ধি-পরামর্শের জন্য গেছেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক এবং পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর বিপরীত রাজনীতির মানুষ অলি আহাদের লেখায় এ তথ্য মেলে।

মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের রাজনীতি থেকে তত দিনে বঙ্গবন্ধু বাংলার আমজনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সূচনা করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তাঁর রাজনৈতিক অভিযাত্রা শুরু হয়, যা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় রূপ নেয় ছয় দফার মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু এটিকে বাঙালির মুক্তিসনদ আখ্যা দিলেন। এর ভিত্তিতেই তাঁরই নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির এক অভূতপূর্ব জাগরণ ঘটে যায়, যা শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতায় চূড়ান্ত পরিণতি পায়।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এবং হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি। তাই ছয় দফার আন্দোলনে একটিই ছিল স্লোগান, জয় বাংলা। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় তাতে যুক্ত হয় আরও অনেক স্লোগান, যার অন্যতম, তোমার-আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। আর ছাত্র-তরুণেরা শেখ মুজিবুর রহমানকে আদরে-শ্রদ্ধায় ডাকল বঙ্গবন্ধু।

বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রাণপুরুষ, জয়বাংলার অগ্রনায়ক, যাঁর মনপ্রাণ ছিল এই বাংলার গণমানুষের কল্যাণচিন্তায় নিবেদিত, যিনি প্রেরণা পেতেন বাঙালি কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের সৃষ্টির মধ্যে, সেই মানুষটি যখন সরকারপ্রধান হিসেবে বিশ্বদরবারে দাঁড়াবেন তখন যে তাঁর মাতৃভাষা বাংলাতেই কথা বলবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বাঙালি চিরকালই স্বাধীনচেতা, ঔপনিবেশিক আমলে সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রামেও যুক্ত ছিলেন কেউ কেউ, কিন্তু পুরো জাতি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে, প্রতিপক্ষও এমনটা ভাবতে পারেনি। আর বাঙালির একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাও ছিল স্বপ্নাতীত। এই প্রথম রাষ্ট্রের সব কাজে ব্যবহৃত হলো বাংলা ভাষা। বাংলা দিনপঞ্জিও মর্যাদা পেল রাষ্ট্রের কাছে। সংবিধানের মূল ভাষ্য রচিত হলো বাংলায়। বাংলা হলো সর্বস্তরের শিক্ষার মাধ্যম। এভাবেই খুলে গেল সবার জন্য শিক্ষার দ্বার। এসব কাজের কান্ডারি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সব সদস্যরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সভায় বাংলায় ভাষণ দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। এ তাঁর অর্জন, তাঁরই অবদান।

এ সময় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতিত্ব করছিলেন আলজেরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল আজিজ বুতেফলিকা। তখনকার বিশ্ব মূলত দুই মেরুতে বিভক্ত। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সংস্থা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন তখন শক্তিশালী ভূমিকায়। বঙ্গবন্ধু শুরুতেই সবার আকর্ষণ এবং বিশ্ব রঙ্গমঞ্চের ভাবী নেতা। সদ্য স্বাধীন দেশ, যে স্বাধীনতা এসেছে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, যে যুদ্ধে তিনিই ছিলেন প্রেরণা, অথচ ৯ মাস ছিলেন বন্দী পাকিস্তানের কারাগারে। ফাঁসি বা হত্যা ছিল যেকোনো সময়ের বাস্তবতা। সেই নেতা দাঁড়িয়েছেন বিশ্বসভায় বিশ্ববাসীর প্রতিনিধিদের সামনে। সারা বিশ্ব আমাদের মুক্তিসংগ্রামের কথা জানত, জানত সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতার কথা। তারা এসব জেনে আলোড়িত হয়েছে। জাতিসংঘ, বিশেষত নিরাপত্তা পরিষদ বারবার বৈঠকে বসেছে, এর বিভিন্ন অঙ্গ সংস্থা এক কোটি শরণার্থীর জীবন বাঁচানোর লড়াইয়ে পুরোটা সময় শামিল ছিল।

বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে ‘সার্বিক অর্থে শান্তি এবং ন্যায়ের সংগ্রাম’ আখ্যায়িত করেছেন। স্পষ্টভাবেই তিনি বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের প‌ক্ষে দাঁড়িয়ে ‘বেআইনি ভূখণ্ড দখল, জনগণের অধিকার হরণের জন্য সেনাবাহিনীর ব্যবহার এবং জাতিগত বৈষম্য ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে’ চলমান সংগ্রামের প্রতি বলিষ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন। সমকালের প্রেক্ষাপটও চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন ভাষণে, ‘একদিকে অতীতের অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটানোর চেষ্টা চলছে, অপর দিকে আমরা আগামীর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি।’ এ প্রেক্ষাপটে তিনি সঠিক অবস্থান গ্রহণে ভুল হলে মানবজাতির ধ্বংস এবং চরম মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু সাহস ও আশাবাদ এবং মানুষের ওপর গভীর আস্থা নিয়েই রাজনীতি করেছেন। তাই সংকটের শঙ্কা জানিয়ে তিনি ‘মানুষের সৃজনশীলতা’ এবং ‘বিজ্ঞান ও কারিগরি অগ্রগতির মাধ্যমে উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের’ স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব যে অর্থনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে ছিল, তাকে ‘একটি ন্যায়সংগত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে’ মোকাবিলা সম্ভব বলে তিনি মনে করেছেন। এ বিষয়ে তাঁর উদ্বেগ খুবই স্বাভাবিক। কারণ, স্নায়ুযুদ্ধ ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের চাপ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে বাংলাদেশ সে বছর খাদ্যাভাবের সংকটে পড়েছিল। সে কথা তিনি ভাষণে উল্লেখও করেছেন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবার ‘অর্থনৈতিক-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সুবিধা ভোগের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্বের কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে’ উল্লেখ করেছেন। শান্তি ও উন্নতির জন্য তাঁর কাছে মৈত্রী ও সমঝোতার গুরুত্ব কতখানি, তা বোঝাতে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ার কথা উল্লেখ করেছেন, ‘অতীতের সমস্ত গ্লানি ভুলে গিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছি।’ আমরা জানি, জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যাওয়ার পথে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে লাহোরে গিয়েছিলেন। তখন দ্বিপক্ষীয় অমীমাংসিত বিষয়ও তুলে ধরেছিলেন ভাষণে।

তবে জাতিসংঘের কাছে মূল প্রত্যাশা যেহেতু মানবতার পক্ষে ভূমিকা পালন, দেশে-দেশে জাতিতে-জাতিতে সমঝোতা ও মৈত্রী স্থাপন, মানুষের ন্যায়সংগত সংগ্রাম ও অধিকার রক্ষায় নিপীড়িত-অবহেলিতের পাশে দাঁড়ানো, তাই বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ যেন তাদের হয়েই শেষ করেছেন। বলেছেন, ‘আমরা দুঃখ ভোগ করতে পারি, কিন্তু মরব না। টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি। আমাদের পথ হচ্ছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টা।’

বর্তমান বিশ্বের সমকালীন বাস্তবতা প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু এমনই এক পরিণতির আশঙ্কা করে আগেই সাবধান করতে চেয়েছিলেন। তাতে এটাও প্রমাণিত হয় যে বিশ্বনেতারা তাঁর এবং তাঁর মতো অন্যদের সাবধানবাণীর প্রতি কর্ণপাত করেননি। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আজও তাঁদের মধ্যে আমরা এই সচেতনতা দেখতে পাই না।

ইতিহাসবিদ ফুকুয়ামা বলেছেন, ইতিহাসের সমাপ্ত। বিজ্ঞানী মার্টিন রিজ বলেছেন, এটিই মানবজাতির চূড়ান্ত শতাব্দী। ট্রাম্প-জনসন-পুতিন, মোদি-এরদোয়ান-বলসোনারোর মতো নেতারা কেবল বিপর্যয়কে ত্বরান্বিত করেছেন। এ সময়ে বিশ্বের প্রয়োজন ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো এক সাহসী, দূরদর্শী, মানবদরদি নেতার, যিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম, যিনি পারেন হতাশাগ্রস্তের মনে আশার উদ্দীপনা এবং সাহসী ভূমিকা গ্রহণের প্রেরণা জোগাতে। তিনি জানতেন মৈত্রী ও সমঝোতার বাতাবরণ প্রসারিত ও দৃঢ়তর করতে। জানতেন, কখন কাকে কতটা ছাড় দিতে হবে, কোথায় প্রতিরোধে অটল থাকতে হবে। আজকের বিশ্ব ও বিশ্ববাসীর দমে যাওয়া আত্মবিশ্বাস, সংকুচিত বিবেক ও ছিন্নভিন্ন ইচ্ছাশক্তিকে সংহত, দৃঢ় ও উজ্জীবিত সক্রিয় করে তুলতে প্রয়োজন তাঁর মতো নেতার বজ্রকণ্ঠের দৃপ্ত আহ্বান।