‘সেকেন্ড হোম’ বাংলাদেশে শেখ হাসিনা মায়ের মতো: লোটে শেরিং

লোটে শেরিংকে অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
ছবি: পিআইডি

শিক্ষাজীবনের একটি অংশ এ দেশে কাটিয়ে যাওয়া ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এসে বাংলাদেশকে নিজের ‘সেকেন্ড হোম’ হিসেবে তুলে ধরলেন। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বললেন ‘মায়ের মতো’।

‘মুজিব চিরন্তন’–এর অষ্টম দিনের আয়োজনে আজ বুধবার সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী। এদিন শুভেচ্ছা জানিয়ে ভিডিও বার্তা দেন ভারতের কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস। অনুষ্ঠানে লোটে শেরিং বাংলাদেশ-ভুটান কূটনৈতিক সম্পর্কর ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত ডাকটিকিট তুলে দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর হাতে।

বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক সাফল্য এসেছে। বাংলাদেশ ও দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক। ৫০ বছর ধরে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিবার বাংলাদেশে আসার সময় নিজের ‘সেকেন্ড হোম’ বলে মনে হয়।’

শেখ হাসিনাকে মায়ের চোখে দেখার কথা জানিয়ে লোটে শেরিং বলেন, ‘এই দেশের মানুষের সৌভাগ্য যে তারা শেখ হাসিনার মতো একজন নেতা পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পিতার স্বপ্ন পূরণে কাজ করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকার কোভিড পরিস্থিতি দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করছে।’

লোটে শেরিং বলেন, ভুটানের রাজা যেভাবে সুখী মানুষের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছেন, ঠিক একইভাবে স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বক্তৃতার শেষে তিনি অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা পঙ্‌ক্তি থেকে উচ্চারণ করেন, ‘যত দিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, তত দিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান...।’

অনুষ্ঠানে লোটে শেরিং বাংলাদেশ-ভুটান কূটনৈতিক সম্পর্কর ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত ডাকটিকিট তুলে দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর হাতে
ছবি: পিআইডি

সভাপতির বক্তব্যে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ভুটানের স্বীকৃতি দেওয়ার দিনটির কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের আগেই রেডিওতে ভুটানের স্বীকৃতি দেওয়ার খবর শোনাটি ছিল অনন্য এক মুহূর্ত। ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থীদের প্রতি ভুটানের স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তার কথাও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, ভুটান বাংলাদেশের প্রাচীন বন্ধু। দুই দেশ একে অপরের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। শিক্ষা, বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ছে। ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশের চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনার বিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি শুধু ভুটানের না, তিনি বাংলাদেশেরও।

ভিডিও বার্তায় কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী বাংলাদেশের মানুষকে এই উদ্‌যাপনে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ৫০ বছর আগে বাংলাদেশের সাহসী মানুষেরা নিজেদের নতুন ঠিকানার লক্ষ্যে লড়াই শুরু করেছিল, যা এই উপমহাদেশের ইতিহাস ও ভৌগোলিক মানচিত্র বদলে দিয়েছিল।

শুভেচ্ছা জানিয়ে ভিডিও বার্তা পাঠান সোনিয়া গান্ধী
ছবি: পিআইডি

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথাও তুলে ধরেন কংগ্রেস নেত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে ভারতের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সাল বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। কারণ, ইন্দিরা গান্ধী শাসক হিসেবে এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় যেমন দিয়েছেন, তেমনি বঙ্গবন্ধু দ্রুত নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করেছেন।

পোপ ফ্রান্সিস ভিডিও বার্তায় বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক ঐক্য, ভাষা নিয়ে সহাবস্থানের আধুনিক নাগরিকের দেশ সোনার বাংলা। দেশটির পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এই ধারাবাহিকতা এসেছে শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকার হিসেবে। বঙ্গবন্ধু এমন এক সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন, যেখানে শান্তি, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার সঙ্গে সব সম্প্রদায় বসবাস করবে।

শরণার্থীদের প্রতি বাংলাদেশ যে মহানুভবতা ও মানবিকতা দেখিয়েছে, তা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ এবং গণতন্ত্রের জন্য শুভকামনা জানান তিনি।

শুভেচ্ছা জানিয়ে ভিডিও বার্তা পড়েন পোপ ফ্রান্সিস
ছবি: পিআইডি

অষ্টম দিনের অনুষ্ঠানের প্রতিপাদ্য ছিল ‘শান্তি, মুক্তি ও মানবতার অগ্রদূত’। বিশ্ব শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা তুলে ধরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো রওনক জাহান অনুষ্ঠানে বলেন, শান্তি, মুক্তি ও মানবতার অগ্রদূত হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি ১৯৭১ সালে বিশ্ব জনমত গঠন ও অর্জনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুর নীতি ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সুষম সমাজব্যবস্থার নীতি। তিনি নিজেকে প্রথমে মানুষ এবং পরে বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিতেন। তিনি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি চেয়েছিলেন। ধর্মীয় রাজনীতির বিরোধী ছিলেন তিনি।

অনুষ্ঠানের শুরুতে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে পৌঁছালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা। জাতীয় সংগীতের পর সম্মানিত অতিথি ও অন্যদের নিয়ে মঞ্চে আসন গ্রহণ নেন শেখ হাসিনা। মহামারির এ সময় তাঁদের সবার মুখে মাস্ক দেখা যায়।

ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে পাঠের পর অন্যান্য দিনের মতো মুজিব চিরন্তন থিমের ওপর টাইটেল অ্যানিমেশন ভিডিও এবং থিম সংগীত দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর অনুষ্ঠানের সঞ্চালক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন স্বাগত বক্তব্য দেন এবং থিমভিত্তিক একটি ভিডিও দেখানো হয়। প্রায় পাঁচ শ জন আমন্ত্রিত অতিথি উপস্থিত ছিলেন। স্পিকার, কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক ও ভুটানের অতিথিরা ছিলেন দর্শকসারিতে।

সাংসদ ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর ধারণ করা বক্তব্য প্রচার করা হয় অনুষ্ঠানে। তিনি জাতীয় চার নেতা, সব মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথির হাতে ‘মুজিব চিরন্তন’ শ্রদ্ধাস্মারক তুলে দেন সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। আলোচনা পর্ব শেষে বিরতির পর হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।