সেতু ঘিরে স্বপ্ন বুনছে মানুষ

জমির দাম বাড়ছে মূলত এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশে ও এর অন্তত পাঁচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করার জন্য জমি কিনছেন।

পদ্মা সেতুর আশপাশ এলাকায় মানুষ নানা সেক্টরে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন। এতে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবেছবি: প্রথম আলো

পদ্মা সেতুর কাজ যতই এগোচ্ছে, ততই দুই প্রান্তের মানুষের স্বপ্ন ডানা মেলছে। আগামী বছর জুনের মধ্যে পদ্মা সেতু চালু করার চিন্তা রয়েছে সরকারের। সেতুকে ঘিরে দক্ষিণের মানুষ ব্যক্তিগত নানা প্রকল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মানুষ সড়কের আশপাশে জমি কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। জাজিরার পর থেকেই সড়কের দুই পাশে এখন বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কিনে রাখা জমির সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। কেউ কেউ জমি কিনে সীমানাপ্রাচীরও তৈরি করেছেন। এই এলাকায় জমির দাম হুহু করে বাড়ছে।

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, এক দশক আগেও জাজিরা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়কের পাশের ও সড়কের আশপাশের জমি বেশ কম দামে কেনাবেচা হতো। সেই সময়ের তুলনায় এখন জমির দাম ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি।

২০০৭ ও ২০০৮ সালে পদ্মা সেতুর জন্য যখন জাজিরার চারটি মৌজায় ১ হাজার ৭০১ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়, তখন সরকারি নির্ধারিত দর (মৌজা রেট) ছিল শতাংশপ্রতি ৭ হাজার ১৫৪ টাকা। বর্তমানে সরকার-নির্ধারিত দর শতাংশপ্রতি ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা। অবশ্য জমি কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, জমির বাজারমূল্য আসলে সরকারি দরের থেকে কয়েক গুণ বেশি।

পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে গত বছর মার্চে খুলে দেওয়া হয়। জমির দাম বাড়ছে মূলত এক্সপ্রেসওয়ের দুই পাশে ও এর অন্তত পাঁচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করার জন্য জমি কিনছেন। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। আবাসন ব্যবসায়ীরাও জমি কিনছেন।

সখিপুর হাজি শরীয়তউল্লাহ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আবুল বাসার আল আজাদের বাড়ি জাজিরার কুন্ডেরচর এলাকায়। ২০১৮ সালে পদ্মার ভাঙনে তাঁদের বসতবাড়ি ও সব ফসলি জমি বিলীন হয়ে যায়। পাশাপাশি অন্তত ১৫০ জন স্বজনের জমি ও বাড়িও বিলীন হয়। বর্তমানে স্বজনদের নিয়ে একটি আবাসিক ও শিক্ষাপল্লি গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। পদ্মা সেতুর টোলপ্লাজা থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে জাজিরার লাউখোলা মৌজায় ২৫ বিঘা জমি কিনেছেন। তাঁদের লক্ষ্য ২০০ বিঘা জমি কেনা।

আবুল বাসার আল আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদ্মা নদীর তীরবর্তী এলাকায় জাজিরার অধিকাংশ মানুষের বসবাস। এলাকাগুলোও অনুন্নত। শিক্ষার অগ্রগতিও কম। পদ্মার ভাঙনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে মানুষ। পদ্মা সেতু আজ রঙিন স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আমরা পদ্মা সেতুর খুব কাছে গ্রামের ভেতর শিক্ষাপল্লি গড়ে তুলব। পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা মিলে জমি কিনছি।’

নাওডোবার বাসিন্দা বাদল জমাদ্দাররা পাঁচ ভাই। পদ্মা সেতু ও রেল প্রকল্পে তাঁদের ২০ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করেছে সরকার। তাঁদের পরিবারের আরও ৭০ বিঘা জমি রয়েছে। এর মধ্যে ২০ বিঘা জমির অবস্থান নাওডোবা এলাকায় রেলস্টেশনের কাছে। ওই জমিতে রিসোর্ট গড়ে তুলতে চায় বাদলের পরিবার।

বাদল জমাদ্দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদ্মা সেতুর টোলপ্লাজা পেরিয়ে পাঁচ মিনিট আসলেই রেলস্টেশন। দুই কিলোমিটার এলাকার মধ্যে পদ্মা নদী। পদ্মার বিশাল জলরাশি ও পদ্মা সেতুর সৌন্দর্য ভ্রমণপিপাসু মানুষকে খুব আকৃষ্ট করবে। এমন ভাবনা থেকে রিসোর্ট ও বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তুলতে চাই। আমাদের ২০ বিঘা জমি রয়েছে, আরও ৩০ বিঘা জমি কিনতে চাই। পরিকল্পনা আছে খুব শিগগিরই প্রকল্পটির কাজ শুরু করব।’

জাজিরার পূর্বনাওডোবা থেকে শিবচরের কাঠালবাড়ি পর্যন্ত অন্তত ১০ কিলোমিটার এলাকা নদীর তীরের জমি পদ্মা সেতুর নিয়ন্ত্রণাধীন। এরপর পদ্মার তীরে একটি বেসরকারি পণ্য খালাসের জেটি নির্মাণ করতে চায় ঢাকার একটি কোম্পানি। তারা ১০০ বিঘা জমি কেনার জন্য মাঠে কাজ করছে। ঢাকার ব্যবসায়ী আলতাফ হোসাইন বলেন, ‘দেশের বাইরের থেকে যেসব পণ্য আমাদের সমুদ্রবন্দরগুলোতে আসে, তা সড়কপথে ঢাকায় আনতে খরচ অনেক বেশি। নৌপথে সেসব পণ্য পদ্মা সেতুর কাছে খালাস করা হবে। এতে সময় ও খরচ সাশ্রয় হবে। আমরা বেসরকারি জেটি নির্মাণ করার জন্য জমি খুঁজছি। জমি পাওয়া গেলে জেটি নির্মাণকাজ শুরু করব।’

শরীয়তপুর সদর উপজেলার ডোমসার গ্রামের বাসিন্দা নাজমুল হক বাদল দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহরে ব্যবসা করেন। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। জুনে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার খবর শুনে তিনি সেতুর আশপাশে মহাসড়কের পাশে হাইওয়ে রেস্তোরাঁ ও রিসোর্ট ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে চান। নাজমুল হক বলেন, ‘আমরা প্রবাসীরা দেশে নিরাপদে বিনিয়োগ করতে চাই। পদ্মা সেতু চালু হলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে গতিশীলতা ফিরে আসবে। সেতুকে ঘিরে পর্যটন গড়ে উঠবে। আমরা সেতু এলাকায় বিনিয়োগ করতে চাই। এলাকায় ঘুরছি, পছন্দের স্থানে জমি খুঁজছি। প্রয়োজনীয় জমি পেলেই কাজ শুরু করব।’

পদ্মা সেতুর টোলপ্লাজা থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে শরীয়তপুর-ঢাকা সড়কের পাশে সরকার শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি নির্মাণকাজ শুরু করেছে। তাঁতপল্লি নির্মাণের জন্য জাজিরায় ৬০ একর ও শিবচরে ৬০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এখন সেখানে চলছে ভূমি উন্নয়নের কাজ।

জাজিরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোবারক আলী সিকদার মাসট্রেড নামে একটি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিক। তিনি গার্মেন্টসপল্লি, কৃষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, শ্রমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও কারিগরি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য ১০০ বিঘা জমি কিনেছেন। তাঁর কেনা জমি জাজিরায় পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে।

মোবারক আলী সিকদার বলেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক দিয়ে পিছিয়ে। এই জনপদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করবে পদ্মা সেতু। সুযোগটি কাজে লাগাতে আমার মতো অনেক উদ্যোক্তা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমি যে বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি, তা বাস্তবায়িত হলে চার থেকে পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।’

শরীয়তপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি এ কে এম ইসমাইল হক বলেন, পদ্মার দক্ষিণ প্রান্তে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের কথা ভেবে জমি কিনছেন। তবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সরকারকে উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে নজর দিতে হবে।

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. পারভেজ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু ঘিরে মানুষ নানা স্বপ্ন বুনছেন। সেতু চালু হলে দেশের জিডিপি বাড়বে। সঙ্গে সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ সুযোগ বাড়বে। মানুষ নানা সেক্টরে বিনিয়োগ করার কথা ভাবছেন। এতে অভাবনীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।