সেমাইয়ের ৯০% বিক্রি ঈদেই

ঈদ উপলক্ষে রাজধানীর মৌলভীবাজারে বিভিন্ন রকমের সেমাইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। গতকাল দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

চালের গুঁড়া বা ময়দা দিয়ে হাতে বানানো সেমাই সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। বাড়িতে হাতে বানানো সেমাইয়ের পরিবর্তে কয়েক দশক আগেই বাজার থেকে সেমাই কেনার প্রচলন শুরু হয়। মূলত বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট কারখানা সেমাই উৎপাদন শুরু করার পর বাজারে তা বেশ জনপ্রিয়তাও পায়। খোলা সেমাইয়ের পরিবর্তে বাজারে প্যাকেটজাত সেমাইয়ের বিক্রি বেড়ে যায়।

তবে দেশের বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো সেমাইয়ের ব্যবসায় আসার পর ধীরে ধীরে ছোট কারখানাগুলো বন্ধ হতে থাকে। এখন সেমাইয়ের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় যুক্ত থাকা বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো। বছরে সেমাইয়ের চাহিদা কত, তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই কোম্পানিগুলোর কাছে। তবে বিভিন্ন কোম্পানির মালিকদের ধারণা, বছরে সেমাইয়ের বাজার ১০০ কোটি টাকার মতো। এর ৯০ শতাংশই বিক্রি হয় ঈদুল ফিতরকেন্দ্রিক বাজারে।

ঈদের কেনাকাটা
# বাজারে ২০০ গ্রাম প্যাকেটজাত লাচ্ছা সেমাই বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকায়।
# এক দশক আগে ২০০ গ্রামের প্যাকেটজাত সেমাই বিক্রি হতো ২৫-৩০ টাকায়।
# দুই দশক আগে আধুনিক কারখানায় তৈরি করা সেমাই জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে।

বাংলাদেশ সেমাই প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি নুরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সেমাইয়ের বাজারে সব থেকে বেশি চলে লাচ্ছা সেমাই। খোলা সেমাই এখন আর মানুষ সেভাবে পছন্দ করে না। একসময় স্থানীয় কারখানায় তৈরি সেমাই খুব জনপ্রিয় ছিল। তবে এখন বনফুল, ওয়েল ফুডসহ নানা কোম্পানির তৈরি লাচ্ছা সেমাই বেশি জনপ্রিয়।

দুই দশক আগেও ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের নানা অঞ্চলে স্থানীয় কারখানায় তৈরি সেমাই মানুষের ঘরে ঘরে দেখা যেত। পুরান ঢাকার চকবাজারের সেমাই ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাজারে প্রতিনিধিত্ব করত রোলেক্স সেমাই, করাচি সেমাই, বিউটি সেমাই, গোল্ডেন সেমাই ও আলাউদ্দিন সুইটমিটের লাচ্ছা সেমাই। সময়ের পরিক্রমায় এসব ব্র্যান্ডের সেমাইও আর বাজারে নেই। চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই পাইকারি বাজারে সেমাইয়ের বহু কারখানা ছিল। সে সময় টুকরিতে ভরে সেমাই বিক্রি হতো। সেগুলোর বেশির ভাগই বন্ধ হয়ে গেছে।

মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় প্যাকেটজাত সেমাই বেশি চলছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। আবার স্বাস্থ্যসচেতনতার কারণে খোলা সেমাইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ কম। তবে এখনো বিভিন্ন শহরে নিম্ন আয়ের মানুষ বসবাস করে এমন কিছু এলাকায় খোলা সেমাই বিক্রি হয়। গ্রামেও এখন প্যাকেটজাত সেমাইয়ের কদর বেশি।

ব্যবসায়ীরা জানান, দুই দশক আগে আধুনিক কারখানায় তৈরি করা সেমাই জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। বিশেষ করে গত এক দশকে প্যাকেটজাত সেমাইয়ের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এখন বাজারে বনফুল, প্রাণ, স্কয়ার, মেঘনা, বসুন্ধরা, ওয়েল ফুড, পারটেক্স কিংবা সজীব গ্রুপের সেমাই বিক্রি হচ্ছে বেশি। এলাকাভেদে ছোট কোম্পানিগুলোও এখন প্যাকেটজাত সেমাই বাজারজাত করছে।

বাজারে দুই ধরনের সেমাই পাওয়া যায়। একটি লাচ্ছা সেমাই। আরেকটি চিকন সেমাই। ময়দা দিয়ে চিকন সেমাই তৈরি হয়। আর লাচ্ছা সেমাই বানাতে ব্যবহৃত হয় ময়দা, ডালডা, তেল ও পানি। একসময় স্থানীয় কারখানাগুলোর নানা রঙের সেমাই বানাত। ক্ষতিকারক রংও মেশানো হতো। এখন সেমাই বানাতে রঙের ব্যবহার খুব একটা দেখা যায় না। মানুষ সচেতন হওয়ায় রং মেশানো সেমাইয়ের চাহিদা নেই বাজারে। চিকন সেমাই সাধারণত সাদা বা লালচে রঙের হয়। রঙের দিক দিয়েও লাচ্ছা সেমাই দুই ধরনের, লালচে ও সাদা। সেমাই তৈরির প্রক্রিয়া অনুযায়ী রঙের পার্থক্য হয়।

বাজারে নানা ব্র্যান্ডের সেমাই থাকলেও দাম মোটামুটি একই। যেমন ২০০ গ্রাম প্যাকেটজাত লাচ্ছা সেমাই বেশির ভাগ কোম্পানির দর ৩৫ টাকা। অর্থাৎ এক কেজি প্যাকেটজাত লাচ্ছা সেমাইয়ের দাম পড়বে ১৭৫ টাকা। আর খোলা সেমাইয়ের পাইকারি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। চিকন সেমাইয়ের দরও একই। এক দশক আগে প্যাকেটজাত ২০০ গ্রামের সেমাই বিক্রি হতো ২৫-৩০ টাকায়। এখন প্যাকেটপ্রতি ৫-১০ টাকা বেড়েছে।

সেমাই তৈরির ক্ষেত্রে প্রথম প্রজন্মের মানুষ চট্টগ্রামের বনফুল অ্যান্ড কোং লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুল মোতালেব প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় ৪০ বছর আগে থেকে তিনি সেমাই তৈরি করে বাজারজাত করে আসছেন। তাঁরা সব সময় গুণগত মানের দিকে নজর দিয়েছেন। তাঁদের ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত সেমাই সারা দেশেই ভালো বিক্রি হয়।

করোনার কারণে এবার সেমাই বিক্রি বাড়েনি বলে জানিয়েছে বিপণনকারী কোম্পানিগুলো। তবে ঈদের পরেই আসল হিসাব পাওয়া যাবে।

সেমাই উৎপাদন ও বিপণনকারী কোম্পানি প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর সেমাই বিক্রির পরিমাণ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কম। তবে গত বছরের করোনাকালীন পরিস্থিতির চেয়ে বিক্রি ভালো।

ব্যবসায়ীরা জানান, সেমাইয়ের চাহিদা মূলত রমজানের ঈদের আগে-পরে। রোজার শুরু থেকেই সেমাই বিক্রি বাড়তে থাকে, চলে ঈদের পর পর্যন্ত। সেমাইয়ের বাজারের দুটি ভাগ আছে। একটি ব্র্যান্ডের সেমাইয়ের বাজার, অন্যটি ব্র্যান্ডহীন খোলা সেমাইয়ের বাজার।

পুরান ঢাকার ব্যবসাকেন্দ্র চকবাজার, মৌলভীবাজার ও ছোট কাটরায় সেমাই বিক্রির পাইকারি দোকানের সংখ্যা প্রায় ৫০টি। ছোট কাটরার পাইকারি সেমাই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ফাইভ স্টার এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ সাগর প্রথম আলোকে বলেন, অন্যবার রমজানের সময় ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এখানে সেমাই কিনতে আসতেন। করোনার সংক্রমণের কারণে এবার পাইকারি বিক্রি কম।