সৌন্দর্যের বেলাভূমে ‘ক্রসফায়ার’

কক্সবাজারের এই দৃষ্টিনন্দন সড়ক ও আশপাশে প্রায়ই বন্দুকযুদ্ধের পর লাশ পড়ে থাকে সন্ধ্যা হলেই মানুষ ওই পথে যায় না।

কক্সবাজার থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে টেকনাফ। পশ্চিমে নীল সমুদ্র। মাছ ধরা ট্রলারগুলো ছুটে চলেছে। সৈকতের বালুচরে দাপাচ্ছে লাল কাঁকড়া। সাগরের গর্জনে মিশে যাচ্ছে গাঙচিলের ডাক। পাশেই ঝাউবন। সেখানে প্রায়ই পড়ে থাকে গুলিবিদ্ধ মানুষের নিস্তেজ শরীর।

মেরিন ড্রাইভের আশপাশের বাসিন্দারা বলছেন, প্রতি সপ্তাহেই কারও না কারও লাশ পড়ে থাকে। কখনো সাগরপাড়ে, কখনো মেরিন ড্রাইভ বা তার আশপাশে। পরে জানানো হয়, পুলিশ বা র‍্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তাঁরা নিহত হয়েছেন। এখানে পার্থক্য শুধু এতটুকুই পুলিশ ও র‌্যাবের পাশে বিজিবিও আছে। দেশের কোনো সীমান্তে বিজিবির গুলিতে কেউ নিহত হওয়ার কথা শোনা না গেলেও কক্সবাজারে প্রায়ই বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হতাহতের খবর মেলে।

পুলিশ ও মানবাধিকারকর্মীদের হিসাব বলছে, ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে সারা দেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর দুই বছরে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ৫৮৬ জন নিহত হয়েছেন। এর প্রায় অর্ধেকই (২৩০ জন) নিহত হয়েছেন কক্সবাজারে। এর অর্ধেক আবার মেরিন ড্রাইভ ও তার আশপাশে। সারা দেশের হিসাবে ক্রসফায়ারে মোট নিহতের প্রতি ছয়জনের একজনের লাশ পাওয়া গেছে এই মেরিন ড্রাইভে।

কক্সবাজারের সচেতন মানুষ ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, দৃষ্টিনন্দন মেরিন ড্রাইভ পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় হলেও এখন তা পরিণত হয়েছে আতঙ্কের সড়কে। সন্ধ্যা হলে সহজে কেউ এ পথ মাড়ায় না। বলতে গেলে, ভোর পর্যন্ত এ সড়কে মানুষের আনাগোনা তেমন থাকে না।

মেরিন ড্রাইভে লাশ পড়ে থাকার কথা স্বীকার করলেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন। কিন্তু লাশের সংখ্যা অত বেশি নয় বলে জানালেন। গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এত বড় একটি সাগরের তীর, যার সবটা পাহারা দেওয়া মোটেই সহজ কাজ নয়। তা ছাড়া মেরিন ড্রাইভে শুধু পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেনি, অন্য সংস্থাও রয়েছে। আবার সন্ত্রাসীদের নিজেদের ভেতর গোলাগুলিতে নিহতের ঘটনা ঘটছে।

কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৮৪ কিলোমিটার সড়কে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর মোট ১১টি তল্লাশিচৌকি থাকার পরও কী করে এত বন্দুকযুদ্ধ হয়, মেরিন ড্রাইভে কেন এখন লাশের মিছিল—এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব নেই পুলিশ সুপারের কাছে। তিনি শুধু বললেন, তল্লাশিচৌকি তো সড়কের ওপর। আশপাশে বন্দুকযুদ্ধ হলে পুলিশ ঠেকাবে কীভাবে।

কথা হয় কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমার সঙ্গে। জানা গেল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের ৬ মে এই সড়ক উদ্বোধন করেন। ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা খরচ করে সড়কটি তৈরি করতে সময় লাগে প্রায় এক যুগ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ প্রকৌশল নির্মাণ ব্যাটালিয়ন (ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন—ইসিবি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। এটি বিশ্বের দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ। কক্সবাজারের কলাতলী থেকে শুরু হয়ে টেকনাফের সাবরাংয়ে শেষ হয়েছে।

দৃষ্টিনন্দন এই সড়ক নির্মাণের পর থেকেই পর্যটকদের প্রথম পছন্দের স্থানে পরিণত হয়। অনেক পর্যটক গাড়ি নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভে কাটাতেন। পরিবার নিয়ে লোকজনকে সারা রাত মেরিন ড্রাইভে বেড়াতে দেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আসতে শুরু করার পরই সব পাল্টে যেতে থাকে। এই সড়কে বসে একাধিক তল্লাশিচৌকি। পর্যটকের সড়ক বদলে যায় নজরদারি সড়কে।

গত ৩১ জুলাই এই সড়কের তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান নিহত হন। এরপর তল্লাশিচৌকির সংখ্যা ও কড়াকড়ি আরও বাড়ানো হয়।

টেকনাফ উপজেলা রেন্ট-এ-কার নোহা মাইক্রোবাস মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রফিক বললেন, আগে টেকনাফ থেকে কক্সবাজারে যেতে সময় লাগত সর্বোচ্চ দেড় ঘণ্টা। তল্লাশিচৌকি বেড়ে যাওয়ায় এখন লাগে দুই থেকে তিন ঘণ্টা।

কক্সবাজারের কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা সেই একরামুল হকের কথা মানুষ ভুলতে পারেনি। পরিবারের সঙ্গে ফোনে থাকা অবস্থায় র‍্যাবের গুলিতে তিনি নিহত হন। গুলির শব্দ তাঁর স্ত্রী-সন্তানেরাও শুনতে পেয়েছিলেন। ২০১৮ সালের ২৭ মের এই আলোচিত ‘ক্রসফায়ার’টি হয়েছিল টেকনাফ উপজেলা সদর ইউনিয়নের নোয়াখালীপাড়া মেরিন ড্রাইভে। একরামুল হকের অসহায় পরিবার এখনো সেখানে গিয়ে চোখের পানি ফেলে।

মেরিন ড্রাইভের এক পাশে উঁচু-নিচু পাহাড়ের সারি, প্রাকৃতিক ঝরনা, টেকনাফের বাহারছড়ায় জেলার সবচেয়ে উঁচু পর্বতমালা ‘তুনাঙ্গানাঙ্গা’। পাহাড়ের নিচে ঘন সুপারি ও নারকেল বাগান, পানের বরজ আর শতবর্ষী গর্জন বন। তার মধ্যে ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুরের শ্যামনগর এলাকার আনিসুর রহমানের ছেলে আজিজুর রহমান আজাদের লাশ পড়ে ছিল ২০১৮ সালের ২৪ আগস্ট। র্যাব তাঁকে ইয়াবা কারবারি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পুলিশের গুলিতে নিহত ইমরান হোসেনের লাশ পড়ে ছিল মেরিন ড্রাইভে। পুলিশের দাবি, ইমরান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি।

মেজর (অব.) সিনহা নিহত হওয়ার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আলোচিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফে যোগদানের পরই মেরিন ড্রাইভে লাশ পড়ে থাকার ঘটনা বাড়তে থাকে। সেখানে প্রথম বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালে ২৪ অক্টোবর। ওই দিন সকালে মেরিন ড্রাইভের মহেষখালিয়াপাড়ায় মফিজ আলম (৩২) নামের এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। তখন ওসি প্রদীপ বলেছিলেন, নিহত ব্যক্তি ইয়াবা কারবারি।

২০১৯ সালের ২৫ জুন মেরিন ড্রাইভের শেষ প্রান্ত টেকনাফে মহেষখালিয়াপাড়া সৈকতে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন কোরবান আলী, আবদুল কাদের ও আবদুর রহমান। এ বছরের ১২ মার্চ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুরে র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সাইফুল ইসলাম ও নুর কামাল নিহত হন। তাঁদের লাশ দীর্ঘ সময় মেরিন ড্রাইভে পড়ে ছিল।

শুধু বন্দুকযুদ্ধই নয়, ইয়াবা ও মানব পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মেরিন ড্রাইভ। এই সড়ক থেকে অনেকবার ইয়াবার চালান ও মাদক পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

উখিয়ার সোনারপাড়ার পানচাষি মোস্তাক আহমদ (৫৫) বলেন, নির্মাণের পর তিন বছরেই মেরিন ড্রাইভ হাজারো মানুষের ভাগ্য পাল্টে দিয়েছে। আগে এই এলাকার এক কানি (৪০ শতক) জমির দাম ছিল ২০-২৫ লাখ টাকা। মেরিন ড্রাইভ হওয়ার পর সেই জমি এখন কোটি টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে এলাকার উন্নয়ন থমকে গেছে।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এই সড়ক ১৫ বছর সেনাবাহিনী ব্যবস্থাপনা করবে। এটি দুই লেনের বদলে চার লেন হবে। এর সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। সবকিছু নির্মিত হলে এসব এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। তখন মেরিন ড্রাইভে মানুষ দিনরাতে অবাধে চলাচল করতে পারবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মেরিন ড্রাইভ পড়েছে ছয়টি ইউনিয়নে। এগুলো হলো কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা, রামুর খুনিয়াপালং, উখিয়ার জালিয়াপালং, টেকনাফের বাহারছড়া, টেকনাফ সদর ও সাবরাং।

টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, বিশ্ব পর্যটনের দুয়ার খুলে দিয়েছিল মেরিন ড্রাইভ। সরকার মেরিন ড্রাইভের শেষ প্রান্তে সাবরাং সৈকতকে ঘিরে বিশেষ পর্যটনপল্লি গড়ে তুলবে। নাফ নদীর জালিয়ারদিয়ায় হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের ‘নাফ ট্যুরিজম পার্ক’। কিন্তু মেরিন ড্রাইভে খুন-খারাবি, বন্দুকযুদ্ধে হতাহতের ঘটনা বাড়তে থাকায় মানুষ আর নিজেকে নিরাপদ মনে করছে না। সন্ধ্যার পর সড়কটি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।

কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক, পরিবেশবাদী আয়াছুর রহমান বললেন, মেরিন ড্রাইভকে আতঙ্কমুক্ত রাখা গেলে এটি হতো বিশ্ব পর্যটনের অন্যতম দুয়ার। মেরিন ড্রাইভকে ঘিরে উপকূলীয় লোকজনের জীবনযাত্রার মান যেমন বদলে যাচ্ছে, তেমনি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে পিছিয়ে পড়া এই জনপদ। কিন্তু ‘বন্দুকযুদ্ধ’র পর লাশ পড়ে থাকার ঘটনা সব সাফল্যকে মাটি করে দিচ্ছে।