স্বজনের খোঁজে আট বছর

রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন সানোয়ার হোসেন ও নুসরাত জাহান দম্পতি। ভবনধসে সানোয়ার বেঁচে গেলেও তাঁর স্ত্রীর সন্ধান আজও মেলেনি
ছবি: সংগৃহীত

‘লাশের খোঁজে দিনের পর দিন হাসপাতালে ঘুরে বেড়িয়েছি। কিন্তু খোঁজ পাইনি আমরা। ভাইবোন হারানোর শোকে আমার মা এখন পাগলপ্রায়,’ কথাগুলো বলছিলেন সাভারের রানা প্লাজা ধসে দুই ভাইবোনকে হারানো শফিকুল ইসলাম। আট বছর আগে দুনিয়াজোড়া আলোড়ন তোলা ওই ঘটনায় শফিকুলদের মতো আরও অনেকেই স্বজনের সন্ধানই এখনো পাননি।

ওই ভবনের একটি পোশাক কারখানার কর্মী সানোয়ার হোসেন হারিয়েছিলেন তাঁর সহধর্মিণীকে। সে সময় তাঁদের ছোট্ট মেয়েটি এখন ১৪ বছরের কিশোরী। মা কোথায় জানতে চাইলে মেয়েকে আর কোনো উত্তর দিতে পারেন না সানোয়ার। তাঁর মতোই ছেলের প্রশ্নে নিরুত্তর হয়ে যান জয়পুরহাটের রেহেলা আক্তার। তাঁর স্বামী মাহেদুল ইসলামও ধসে পড়ার কয়েক ঘণ্টা আগে রানা প্লাজায় কাজে ঢুকেছিলেন।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে ধসে পড়ে সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছে নয়তলা ভবন রানা প্লাজা। ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে থাকা পাঁচটি পোশাক কারখানার শত শত শ্রমিক ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েন। কয়েক সপ্তাহ ধরে সেখানে উদ্ধার অভিযান চলে। এ ঘটনায় প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক। গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন ১ হাজার ১৬৯ জন।

নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১০৩ জনের লাশ আজও শনাক্ত হয়নি। তাঁদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে রাজধানীর জুরাইনে বেওয়ারিশ হিসেবে কবর দেওয়া হয়।
জাতীয় ফরেনসিক ল্যাবের কারিগরি উপদেষ্টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক শরীফ আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে রানা প্লাজা ধসে নিহত শতাধিক মানুষের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে তাঁদের ডিএনএ নমুনা সংরক্ষিত আছে। আত্মীয়স্বজনের দেওয়া ডিএনএ নমুনার সঙ্গে তাঁদের ডিএনএ নমুনার মিল পাওয়া যায়নি।

রানা প্লাজা ধসে মারা যাওয়া ৮০০ জনের মরদেহ হস্তান্তরের সময় তাঁদের কোনো ডিএনএ নমুনা সংরক্ষণ করা হয়নি বলে জানান তিনি। এই অধ্যাপকের মতে, প্রতিটি মরদেহের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহে রাখা উচিত ছিল। তাতে অশনাক্ত মৃতদেহের সংখ্যা কম থাকত।

যাঁরা এখনো স্বজনের সন্ধান পাননি, তাঁদের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু করা হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. রেজাউল হক মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, রানা প্লাজা ধসে নিহত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করে তাঁদের প্রকৃত উত্তরাধিকারদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। বেওয়ারিশ হিসেবে কবর দেওয়া ১০৩ জনের পরিচয় শনাক্তকরণের প্রক্রিয়াটি অব্যাহত থাকবে কি না, সে বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে। এ বিষয়টি তিনি কর্তৃপক্ষের নজরে আনবেন।

‘লাশটা আমরা খুঁজে পেলাম না’

দিনমজুর স্বামীর মৃত্যুর পর ছোট ছোট ছয় ছেলেমেয়েকে নিয়ে বড় কষ্ট করতে হয় আনোয়ারা বেগমকে। সন্তানদের মুখে খাবার জোগাড়ই হয়ে পড়ে দুঃসাধ্য। একপর্যায়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে সাভারে চলে আসেন তিনি। তাঁর এক ছেলে হাবিবুর রহমান (২২) এবং মেয়ে ঝুমা খাতুন (২৬) কাজ নেন রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানায়। অন্যান্য দিনের মতো ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে সাতটায় কাজের জন্য বাসা থেকে বের হয়ে যান তাঁরা। ঘণ্টা দুয়েক পর ভবনটি ধসে পড়ার খবর পান আনোয়ারা। তখন ছোট ছেলে শফিকুলকে নিয়ে তিনি ছুটে যান ধ্বংসস্তূপের সামনে। একের পর এক লাশ বেরিয়ে এলেও তাঁর দুই সন্তানের কোনো সন্ধান পাননি এই মা।

শফিকুল জানান, ভাইবোনের খোঁজে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেছেন তিনি। কিন্তু কোথাও তাঁদের সন্ধান মেলেনি। পরে মাসহ তিনি নিজে ডিএনএ নমুনা দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। বিছানায় কাটছে অসুস্থ মায়ের দিন।

শফিকুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। মা অনেক কষ্ট করে আমাদের বড় করে তুলেছেন। তাঁর দুই সন্তান রানা প্লাজা ধসে মারা গেছে। কিন্তু লাশটা আমরা খুঁজে পেলাম না।’

দিনমজুর স্বামীর মৃত্যুর পর ছোট ছোট ছয় ছেলেমেয়েকে নিয়ে বড় কষ্ট করতে হয় আনোয়ারা বেগমকে। সন্তানদের মুখে খাবার জোগাড়ই হয়ে পড়ে দুঃসাধ্য। একপর্যায়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে সাভারে চলে আসেন তিনি। তাঁর এক ছেলে হাবিবুর রহমান (২২) এবং মেয়ে ঝুমা খাতুন (২৬) কাজ নেন রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানায়। অন্যান্য দিনের মতো ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে সাতটায় কাজের জন্য বাসা থেকে বের হয়ে যান তাঁরা। ঘণ্টা দুয়েক পর ভবনটি ধসে পড়ার খবর পান আনোয়ারা। তখন ছোট ছেলে শফিকুলকে নিয়ে তিনি ছুটে যান ধ্বংসস্তূপের সামনে। একের পর এক লাশ বেরিয়ে এলেও তাঁর দুই সন্তানের কোনো সন্ধান পাননি এই মা।

শফিকুল জানান, ভাইবোনের খোঁজে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেছেন তিনি। কিন্তু কোথাও তাঁদের সন্ধান মেলেনি। পরে মাসহ তিনি নিজে ডিএনএ নমুনা দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। বিছানায় কাটছে অসুস্থ মায়ের দিন।

শফিকুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। মা অনেক কষ্ট করে আমাদের বড় করে তুলেছেন। তাঁর দুই সন্তান রানা প্লাজা ধসে মারা গেছে। কিন্তু লাশটা আমরা খুঁজে পেলাম না।’

‘আব্বু, আম্মু কোথায়?’

ভাগ্যবদলের আশায় ১১ বছর আগে জামালপুর থেকে স্ত্রী নুসরাত জাহানকে নিয়ে ঢাকায় আসেন সানোয়ার হোসেন। স্নাতক পাস সানোয়ার কাজ নিয়েছিলেন রানা প্লাজায় নিউ ওয়েব স্টাইল নামের একটি কারখানার মানবসম্পদ বিভাগে। সে কারখানায়ই সেবিকা পদে নিয়োজিত ছিলেন নুসরাত। তাঁদের কারখানাটি ছিল রানা প্লাজার সাততলায়।

সানোয়ার বলেন, রানা প্লাজায় ফাটল ধরার খবর আগেই জানতেন তিনি। তবু গার্মেন্টমালিকের চাপে বাধ্য হয়ে তাঁরা সেদিন কারখানায় গিয়েছিলেন। ভবনটির ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছিলেন সানোয়ার। পরে তাঁকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি বেঁচে যান। তবে তাঁর স্ত্রী নুসরাত মারা যান। কিন্তু আজও স্ত্রীর লাশের সন্ধান পাননি। স্ত্রীর লাশের খোঁজে দিনের পর দিন হাসপাতাল, কবরস্থানে ঘুরেছেন। স্ত্রীর স্বজনেরা ডিএনএ নমুনাও দিয়েছেন। কিন্তু কারও সঙ্গে তাঁদের ডিএনএ মেলেনি।

রানা প্লাজা ধসের সময় তাঁদের ছয় বছরের মেয়েটির বয়স এখন ১৪ বছর। পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। সানোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, আমি এবং আমার স্ত্রী একই কারখানায় কাজ করতাম। আমি বেঁচে গেলাম, আমার স্ত্রী মারা গেল। কিন্তু আজও লাশটা খুঁজে পেলাম না। আমার মেয়ে প্রায়ই বলে, “আব্বু—আম্মু কোথায়?” মেয়েকে আমি কোনো জবাব দিতে পারি না।’

‘শুধু জানতে চাই কবরটা কোথায়’

জয়পুরহাটের মাহেদুল ইসলাম স্ত্রী রেহেলা আক্তারকে নিয়ে থাকতেন সাভারে। কাজ করতেন রানা প্লাজায় অবস্থিত একটি পোশাক কারখানায়। আর রেহেলা কাজ করতেন পাশের আরেকটি কারখানায়। রানা প্লাজা ধসের খবর শুনে পাঁচ বছরের ছেলে রমিনকে নিয়ে সেখানে ছুটে যান রেহেলা। খুঁজতে থাকেন স্বামী মাহেদুলকে। তবে তাঁর সন্ধান আজও পাননি। সে সময় বাবাহারা ছোট্ট রমিন আজ কিশোর।

রেহেলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কখনো ভাবিনি, আমার স্বামী এভাবে মারা যাবে। লাশ খুঁজে পাব না, অথচ আমি বেঁচে রব। আমার ছেলে জানতে যায়, বাবা কোথায়? আমি এর কোনো জবাব দিতে পারি না। শুধু বলি, তোমার বাবা রানা প্লাজা ধসে মারা গেছে। কিন্তু কোথায় তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছে, তা আজও জানি না। স্বামীর কবরটা কোথায়, সেটাই শুধু জানতে চাই।’