স্বপ্ন ও সংগ্রামের সুফিয়া কামাল

সুফিয়া কামাল: অন্তরঙ্গ আত্মভাষ্য
আবুল আহসান চৌধুরী ।প্রথমা প্রকাশন

‘ওই তো, লক্ষ ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনি দামাল,/ সবুজ দ্বীপের মতো মাঝখানে সুফিয়া কামাল।’ কবি সুফিয়া কামালকে (২০ জুন ১৯১১—২০ নভেম্বর ১৯৯৯) নিয়ে এক গানে শিল্পী কবীর সুমন যথার্থই শনাক্ত করেছেন তাঁর মাতৃমূর্তি, সবুজ দ্বীপের মতো বাংলাদেশের হৃদয়জুড়ে তাঁর বসতি।

সারা জীবন তিনি ব্যক্তিগত দুঃখের সঙ্গে ঘর করেছেন; জন্মের পরপর সুফি পিতা গৃহত্যাগ করেছেন, প্রথম স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনের অকালমৃত্যু, ২০ বছর বয়সী পুত্রের আততায়ীর হাতে মৃত্যু, ১৯৪১ সালে মায়ের মৃত্যু, ১৯৭১-এ এক জামাতার মৃত্যু, ১৯৭৭ সালে স্বামী কামালউদ্দীন খানের মৃত্যু দেখেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত শোকে কাতর হয়ে তিনি বিস্মৃত হননি বৃহত্তর কর্তব্যের আহ্বান। মালেকা বেগম যেমনটি বলেন, ‘ব্যক্তিগত শোক তিনি ভোলেননি কখনো। কিন্তু বৃহত্তর পৃথিবীর শোকাতুর মানুষের কথা মনে রেখে তিনি নিজের দুঃখ-বেদনা ঢেকে রেখেছেন নিজের অন্তরের গহিন তলদেশে।’ (সুফিয়া কামাল, মালেকা বেগম, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৪)

বরিশালের শায়েস্তাগঞ্জে গত শতকের গোড়ার দিকে জন্ম নেওয়া সুফিয়া নামের মেয়েটির দেশের মানুষের কাছে ‘জননী সাহসিকা’ হিসেবে বৃত হওয়ার ইতিবৃত্তের সঙ্গে যেন আমাদের জাতীয় ইতিহাসই বর্ণিত হয়ে যায়। ‘সৈনিক বধূ’ গল্প দিয়ে যাঁর সাহিত্যিক সূত্রপাত, ক্রমান্বয়ে তিনি ভেতরের নিভৃত কোলাহল প্রকাশের স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পেলেন কবিতার জগতে। পথিকৃৎ মুসলিম নারী হিসেবে বিমান উড্ডয়ন, সওগাত পত্রিকার পাতায় সচিত্র রচনা প্রকাশ, বেগম রোকেয়ার আদর্শে নারীশিক্ষা বিস্তার ও নারীমুক্তির সংগ্রামে আত্মনিয়োগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনের কলকাতাপর্ব যেমন মহিমান্বিত, তেমনই জীবনের উষালগ্নেই রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের আশীর্বাদের আভায় স্নাত। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর কবিতার অনুরাগী, নজরুল তাঁর কবিতার বই সাঁঝের মায়ার আলোচনা-লেখক। লিখেছেন তিনি, ‘সাঁঝের মায়ার কবিতাগুলি সাঁঝের মায়ার মতই যেমন বিষাদ-ঘন তেমনি রঙিন—গোধূলির রংয়ের মত রঙিন। এ সন্ধ্যা কৃষ্ণা-তিথির সন্ধ্যা নয়, শুক্লা চতুদর্শীর সন্ধ্যা। প্রতিভার পূর্ণচন্দ্র আবির্ভাবের জন্য বুঝি এমনি বেদনাপুঞ্জিত অন্ধকারের, বিষাদের প্রয়োজন আছে।’

নজরুল-কথিত কবির অন্তর্গত বেদনা-বিষাদকে কীভাবে সুফিয়া কামাল জাতির দীর্ঘ প্রতিরোধী চৈতন্য নির্মাণের কাজে রূপান্তর করেছেন, তার উল্লেখ পাই সুফিয়া কামালের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপনের প্রস্তাবনা হিসেবে আবুল আহসান চৌধুরীর লেখায়, ‘দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে সব সময়ই পালন করেছেন নির্ভীক দিশারির ভূমিকা। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সক্রিয় সাহসী ভূমিকা পালন করেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ, রবীন্দ্রবর্জনের সরকারি উদ্যোগের বিরোধিতা, রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন, উনসত্তরের গণ–আন্দোলনে সরকারি খেতাব বর্জন, সত্তরের প্রলয়ংকরী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানো, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনসহ সব কর্মসূচিতে মহিলাদের অনুষ্ঠানে নেতৃত্বদান—তাঁর সমাজ ও স্বদেশমনস্ক বিবেকি চেতনার স্মারক। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত স্বৈর-সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম-প্রতিবাদও কখনো থেমে থাকেনি।’ (সুফিয়া কামাল: অন্তরঙ্গ আত্মভাষ্য, আবুল আহসান চৌধুরী, প্রথমা প্রকাশন, প্রথম প্রকাশ: ২০১০)

সুফিয়া কামাল
মালেকা বেগম । প্রথমা প্রকাশন

এটা অবাক বিস্ময়ের যে গভীর সংবেদনে যিনি লিখেছেন সাঁঝের মায়া, মায়া কাজল, উদাত্ত পৃথিবী, মৃত্তিকার ঘ্রাণ-এর মতো কবিতার বই, সেই তিনিই আবার মাতৃমঙ্গল বা আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলামের মতো সেবা সংগঠন থেকে শুরু করে ছায়ানট, মহিলা পরিষদ বা রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলার কয়েক প্রজন্মের শিশু–কিশোরদের প্রিয় কবি সুফিয়া কামাল তাঁদের জন্য যেমন ইতল–বিতল আর নওল কিশোরের দরবার–এর মতো বই লিখেছেন, তেমনই এ তো সবারই জানা যে তাঁর তারাবাগের বাড়ির চত্বরেই ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় শিশু–কিশোর সংগঠন কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা। ঢাকার ওয়ারী থেকে সোভিয়েত রাশিয়ার মস্কো পর্যন্ত নারী আন্দোলন ও মানবমুক্তির সংগ্রামে তাঁর জীবনব্যাপী পরিক্রমাকে মালেকা বেগম বিধৃত করেছেন তাঁর গবেষণাগ্রন্থ রাজপথে জনপথে সুফিয়া কামাল-এ (আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৭)।

বর্ণাঢ্য সংগ্রামমুখর জীবনকে আত্মজৈবনিক বড় ক্যানভাসে ধারণের সুযোগ তিনি পাননি। যদিও একালে আমাদের কাল আর একাত্তরের ডায়েরীর সংক্ষিপ্ত পরিসরে পাওয়া যায় যুগপৎ সুফিয়া কামাল এবং বাংলাদেশের শতাব্দীপ্রায় অভিযাত্রার বিশ্বস্ত বিবরণ।

সুফিয়া কামালের প্রথম গল্পের বইয়ের নাম কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭)। এই নামের মতোই সারা জীবন তিনি কাঁটা পেরিয়ে ফুলের সন্ধান করেছেন। আমরা স্মরণ করতে পারি ১৯২৭ সালে বিপর্যস্ত নজরুলের জন্য মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনকে লেখা তাঁর কাতর চিঠিটি, ‘তার (নজরুলের) মা-ও মারা গেছে শুনলুম। এখন কাজী কোথায় আছে ও তার স্ত্রী-পুত্র কোথায় আছে, অনুগ্রহ করে সত্বর জানাবেন। আমি কাজীর বোন, আমাকে অনুগ্রহ করে কষ্ট স্বীকার করে সব কথা জানাবেন ও তার দিকে একটু খেয়াল রাখবেন।’

শুধু নজরুলের পাশে বোন হয়ে তো নয়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিরাশ্রয় মানুষের পাশে ভরসার বাড়িঘর হয়ে, লাঞ্ছিত নারীর পাশে মমতাময়ী মা হয়ে, শীতার্ত পথশিশুর গায়ে সহযোগিতার ওম হয়ে ছিলেন একজন সুফিয়া কামাল। স্বপ্ন দেখেছেন এক সুষম আগামীর, আর নিজের বেঁচে থাকার বর্তমানকে উৎসর্গ করেছেন মানুষের ভবিষ্যৎ মুক্তির সংগ্রামে। কবি শামসুর রাহমানের কবিতার পঙ্‌ক্তি তাঁকে এঁকে রেখেছে অমর শব্দচিত্রে, ‘অন্ধকারে যিনি বারবার হেঁটেছেন রাজপথে/ জ্বলন্ত মশাল হয়ে নির্ভুল।’