স্বপ্ন তবু সম্মুখযাত্রার

রণেশ দাশগুপ্ত

‘সদাজাগ্রত এক মানুষ ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। বাঙালির ছয় দশকের সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। সমস্ত পৃথিবীর সৃষ্টিশীল ভান্ডার থেকে আহরণ করেছিলেন শ্রেষ্ঠ শিল্প-সাহিত্যের নির্যাসগুলো। শুদ্ধ রুচি গড়ে তুলেছেন অসংখ্য পাঠকের। সেতুবন্ধ তৈরি করেছেন বিশ্বের সঙ্গে বাংলার।’ (মতিউর রহমান, আকাশভরা সূর্যতারা)

রণেশ দাশগুপ্তকে (১৯১২-৯৭) এককথায় একজন বিপ্লবী সন্ত। বছর পঁচাশির জীবনে আসাম, রাঁচি, বাঁকুড়া, কলকাতা, বরিশাল, ঢাকা, আগরতলার মতো বিচিত্র জায়গায় তাঁর বেড়ে ওঠা, শিক্ষালাভ, বিপ্লবপ্রয়াস ও সাহিত্যসাধনা। বিপ্লবীর তীব্রতা আর সন্তের সৌম্যতা প্রয়াণের দুই যুগ পরও তাঁকে করে রেখেছে স্মরণীয়। এক জীবনে দায়বদ্ধ সাংবাদিক ও সম্পাদক (সোনার বাংলা, সংবাদ), অনন্য সংগঠক (১৯৪০ সালে ঢাকায় প্রগতি লেখক সংঘ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা, প্রতিরোধ পাবলিশার্স প্রতিষ্ঠা, সাহিত্য সংকলন ক্রান্তির প্রকাশ-প্রচেষ্টা), সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আর রক্ষণশীল পাকিস্তানি পরিবেশে প্রগতিশীল বাম রাজনীতি বিকাশের অন্যতম অনুঘটক রণেশ দাশগুপ্ত।

বাঁকুড়ার অনুশীলন সমিতি বা বরিশালের জাগরণী গোষ্ঠী তাঁর সমষ্টিচেতনার স্মারক। তিনি বিশ্বাস করতেন একতায়। জেলখানায় অনশনে বসেছেন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার নতুন ধারা চালু করেছেন। কারাগারে মুনীর চৌধুরীর কবর নাটক রচনা ও মঞ্চায়নের নেপথ্যে রণেশ দাশগুপ্তের ভূমিকা আমরা জানি। মানবতাবাদী উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে বাংলায় পরিচিত করানোর ইতিকথাও অজানা নয়।

১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের আদি পর্ব থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত রণেশ দাশগুপ্তকে দেখি মুক্তির অতন্দ্র সৈনিক হিসেবে। বেতারকথিকা, লেখা, বক্তৃতা ও জনমত গঠনের মধ্য দিয়ে আগরতলা এবং কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা চালিয়েছেন। একাত্তরেই তাঁর লড়াই শেষ হয়নি। বাংলাদেশ প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে পতিত হলে তিনি প্রতিবাদী নির্বাসনও বরণ করেছেন। রেখে গেছেন উপন্যাসের শিল্পরূপ, শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে, ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিসংগ্রাম, আলো দিয়ে আলো জ্বালা, আয়ত দৃষ্টিতে আয়ত রূপ, সাম্যবাদী উত্থানপ্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা, সাজ্জাদ জহীর প্রমুখ, মনে মনে, কখনো চম্পা কখনো অতসী, সেদিন সকালে ঢাকায়, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতা বা জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভার-এর মতো মৌলিক, অনূদিত ও সম্পাদিত একগুচ্ছ গ্রন্থ।

দুই

রণেশ দাশগুপ্তের কুড়িতম প্রয়াণবার্ষিকীতে তাঁর নিকটজন মতিউর রহমানের সংগ্রহ, সংকলন ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় যদিও হাওয়া উল্টোপাল্টা গদ্যসংকলন। একুশে ফেব্রুয়ারি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী, রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবী, সমাজতন্ত্র, জেলখানার গল্প, অনুবাদ কবিতা শিরোনামে আট অধ্যায়ে বিন্যস্ত হয়েছে প্রায় ৫০টি রচনা। বিভিন্ন সময়ে সম্পাদক এসব সংগ্রহ করেছেন কলকাতায় স্বেচ্ছানির্বাসিত রণেশ দাশগুপ্তের কাছ থেকে। তাঁর সঙ্গে ১৯৬৩ সালে রণেশ দাশগুপ্তের সম্পর্কের যে সূত্রপাত, পরবর্তী ৩৪ বছর তা অব্যাহত ছিল।

এ বইয়ের প্রবন্ধগুচ্ছের প্রকাশপর্ব সম্পর্কে বুঝতে মতিউর রহমানের শরণ নিতে হয়, ‘দীর্ঘদিনের বিরতিতে আবার রণেশদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়—সম্ভবত ১৯৮৬-র দিকে। ওই সময় আমার শারীরিক অসুস্থতার কারণে পাঁচ-ছয় বছর ধরে বেশ কয়েকবার চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গিয়েছি।...প্রতিবার রণেশদার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বলে আসতাম, কলকাতায় আপনার যেখানে যে লেখা বেরোবে, সেগুলোর একটি করে কপি রেখে দেবেন। আমি পরে এলে আপনার কাছ থেকে নিয়ে যাব। তবে কখনো কখনো আমাদের কোনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কলকাতায় দেখা হলে তিনি তাঁদের হাতেও আমার জন্য তাঁর প্রকাশিত লেখা পাঠাতেন। এভাবে তিনি ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত অনেক লেখা আমাকে দিয়েছেন। সেসব সংগ্রহ থেকে কিছু প্রবন্ধ নিয়ে ১৯৮৮ সালে জ্ঞান প্রকাশনী থেকে আমাদের উদ্যোগে রণেশদার মুক্তিধারা বইটি প্রকাশিত হয়। এরপর বেশ কয়েক বছর কলকাতায় যাওয়া হয়নি। তবে তাঁর জীবনের শেষ দিকে কয়েকবার দেখা হলে—১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে আরও কিছু লেখা সংগ্রহ করি।’ (সম্পাদকের কথা, পৃ. ১৫-১৬)।

যদিও হাওয়া উল্টোপাল্টা রণেশ দাশগুপ্ত
প্রথমা প্রকাশন

সম্পাদক আক্ষেপ করেছেন এই বলে যে রণেশদার জীবদ্দশায় অথবা ২০১২ সালে তাঁর জন্মশতবর্ষে বইটি প্রকাশিত হলো না। তবে দেরিতে হলেও এই অসাধারণ গদ্যসংকলন যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রকাশ পেল। অমর একুশকে রণেশ দাশগুপ্ত সম্বোধন করেন ‘মহাবিদ্রোহ’ হিসেবে। জার্মান কথাকার টমাস মানের আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁর লেখায় অবধারিতভাবে চলে আসেন বাংলার চিত্রকর জয়নুল আবেদিন। লোককবি রমেশ শীলকে অবলোকন করেন ‘বিপ্লবী লোকচৈতন্যের ভান্ডারি কবিয়াল’ হিসেবে। গণমুক্তির ময়দানে রংতুলি নিয়ে পথে নামেন শিল্পী, তাই তিনি রণেশ দাশগুপ্তের চোখে ‘কমরেড পাবলো পিকাসো’।

চার্লি চ্যাপলিনের আত্মজীবনী নিয়ে লিখতে গিয়ে যখন তিনি বলেন, ‘চিন্তাও ছিল তাঁর কাজেরই অংশ।’ তখন উপলব্ধি করি রণেশ দাশগুপ্তের নিজের কথাও, যিনি নিজে ছিলেন এক অনলস চিন্তাসক্রিয় মানুষ।

কথাশিল্পী সোমেন চন্দকে তিনি অভিহিত করেন ‘বাংলা ছোটগল্পের সুকান্ত’ হিসেবে। আবার কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যকে নিয়ে তাঁর মত সনাতনী সমাজতন্ত্রীদের মতো ছকবাঁধা নয়। বিপ্লবী মানবতাবাদী উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতার সূত্র ধরে বাংলা কবিতার গণস্বর আবিষ্কৃত হয় এভাবে, ‘বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের পর আধুনিক কবিরা জনগণের সঙ্গে সঙ্গে চলেছেন আধুনিক রীতির কবিতা নিয়ে। যেখানেই বিচ্ছেদ ঘটেছে, সেখানেই কবিতার তার ছিঁড়েছে। যখনই সংযোগ হয়েছে প্রত্যক্ষ প্রতিমুহূর্তের গণ-অভিজ্ঞতার সঙ্গে কবিতার, তখনই ঝমঝম করে বেজে উঠেছে হাজার তারের বীণা।’

মাওলানা আবুল কালাম আজাদের দিনলিপিতে প্রাপ্ত সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগ্রামের তথ্যসূত্র থেকে শুরু করে অকালপ্রয়াত সাংবাদিক আহমেদুর রহমান রচিত সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ইশতেহার ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ রণেশ দাশগুপ্তের অনন্য বিশ্লেষণ-সংশ্লেষণে আমাদের কাছে ধরা দেয় ইতিহাসের অবিরাম ধারাবাহিকে। তিনি সমাজতন্ত্রকে যান্ত্রিক ফ্রেমে না দেখে দেখতে চান মির্জা গালিবের কবিতার অক্ষরে: ‘পাথর কাটা ছেনি আর খন্তাই ফরহাদকে শিরিনের/ সহমর্মী করেছিল/ যে ধরনেরই হোক যার মধ্যে যে নৈপুণ্য থাকুক/ সেটাই ভালো।’

অর্ধশতাব্দী পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদ প্রকাশিত একুশের সংকলন বজ্রে বাজে বাঁশি থেকে সংগৃহীত আহমদ নদিম কাসমির লেখা ‘বসন্ত’ কবিতাটির রণেশ দাশগুপ্তের অনুবাদের উল্লেখেই সমাপ্ত হতে পারে এই আলোচনা: ‘এত সুরভি যে দম আটকে আসে/ এমন করেই এল এবার/ বাঁধভাঙা বসন্ত।/ মালঞ্চের কুসুমিত হাওয়া তো নয়/ এ যেন আগুন জ্বলা,/ বর্ণকে যদি অগ্নিশিখা বলি/ গন্ধকে বলব স্ফুলিঙ্গ।’

চারদিকে যদিও হাওয়া উল্টোপাল্টা, তবু মানুষের মুক্তির মালঞ্চের দিকে রণেশ দাশগুপ্তদের মতো বিপ্লবী সন্তের অভিযাত্রা এমনই বসন্তের মতো—ফুলের বর্ণ যেখানে অগ্নিশিখা, গন্ধ যেখানে স্ফুলিঙ্গ।