স্বপ্ন পূরণের সুযোগ চায় কিশোরীরা

‘বলি কথা অকপটে’ শিরোনামে ‘কেয়ার সংলাপ’। মেয়েদের বোঝা মনে না করে সম্পদ ভাবার আহ্বান

অর্পিতা বসুনিয়া,হনুফা ঋতু, মনিরা আক্তার, রিমা আক্তার

তোমার চোখে সমান ভবিষ্যৎ কেমন? উত্তরে এল, ‘ভাইয়ের সঙ্গে আমার তফাৎ না করে স্বপ্ন পূরণের সুযোগ দিতে হবে।’

বাধা কীভাবে দূর হবে বলে মনে করো? অকপট উত্তর, ‘আমার মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।’

‘বলি কথা অকপটে’ শিরোনামে ‘কেয়ার সংলাপ’-এ এভাবেই নিজের চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশা এবং মেয়ে হওয়ার কারণে পরিবার ও সমাজে কীভাবে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মুখোমুখি হয়, তা তুলে ধরেছে কিশোরীরা। তারা রংপুরের পীরগাছা উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ভার্চ্যুয়াল এই সংলাপে আলোচক হিসেবে যুক্ত হয়। ১১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার বেলা তিনটায় এই সংলাপের আয়োজন করে কেয়ার বাংলাদেশের টিপিং পয়েন্ট ইনিশিয়েটিভ এবং দ্য কেনডেডা ফান্ড। অনুষ্ঠানটির সম্প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো

অনুষ্ঠানে কিশোরীরা বাল্যবিবাহ দিয়ে তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নকে বাধাগ্রস্ত না করার আহ্বান জানায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে। আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা মেয়েদের বোঝা মনে না করে সম্পদ ভাবার আহ্বান জানান।

সংলাপে কিশোরীদের অনুপ্রেরণাকারী হিসেবে অংশ নেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের কর্মসূচি কর্মকর্তা (জেন্ডার) তাহমিনা হক, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) কর্মসূচি বিশ্লেষক হুমায়রা ফারহানাজ, নারীর অধিকারবিষয়ক বেসরকারি সংগঠন নারীপক্ষের সদস্য কামরুন নাহার এবং কেয়ার বাংলাদেশের টিপিং পয়েন্ট ইনিশিয়েটিভের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ও জ্যেষ্ঠ কারিগরি সমন্বয়ক (জেন্ডার মেইনস্ট্রিমিং) রওনক জাহান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।

কিশোরী আলোচক ছিল অর্পিতা বসুনিয়া, মনিরা আক্তার, রিমা আক্তার ও হনুফা ঋতু। টিপিং পয়েন্ট ইনিশিয়েটিভের কর্ম এলাকা রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ৩৪টি গ্রামে ‘ফান সেন্টার কার্যক্রম’ রয়েছে। উল্লিখিত চার কিশোরী যোগ দেয় দেউতি, শরিফসুন্দর, মিরাপাড়া ও আনন্দধনীরাম ফান সেন্টার থেকে।

অর্পিতা বসুনিয়া বলে, মেয়ের বান্ধবী নিজে বিয়ে করে ফেলেছে বলে মা-বাবা যেন প্রভাবিত হয়ে মেয়েকে বন্দী না করে ফেলেন, বাল্যবিবাহ না দিয়ে দেন। তার কথা, ‘আমরা আমাদের স্বপ্ন পূরণের অধিকার রাখি। লক্ষ্য পূরণের পথে আমাদের বাধাগ্রস্ত করবেন না। আমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমার মতামতকে গুরুত্ব দিন।’

আরেক কিশোরী হনুফা ঋতু বলে, ‘আমার চোখে সমান ভবিষ্যৎ হচ্ছে ছেলে-মেয়ে ভেদাভেদ না করে সমান অধিকার দেওয়া এবং আমার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া। অথচ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের বঞ্চনার মুখে পড়তে হয়।’

রিমা আক্তারের বাড়ি থেকে স্কুল দেড় কিলোমিটার দূরে। সমবয়সী চাচাতো ভাই সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায়। তা দেখে রিমাও বাবার কাছে সাইকেল কিনে দেওয়ার আবদার করেছিল। তবে ‘তুমি মেয়ে, তুমি পারবে না’ বলে শুরুতেই তা নাকচ করে দেন বাবা। তবে রিমা নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নিজের মা-বাবাকে বাল্যবিবাহের কুফল বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। এখন সে অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে চায় সচেতনতার এই বার্তা।

ইউনিসেফের তাহমিনা হক বলেন, কিশোরীরা এখন বাল্যবিবাহের কুফল ও নিজেদের অধিকার বিষয়ে জানতে পারছে এবং প্রতিবাদ করছে। একটি পরিবারে মেয়েটিকে বোঝা মনে না করে সম্পদ ভাবার বোধ আসতে হবে। কিশোরীদের ক্ষমতায়নে সরকার, পরিবার, সমাজের এই বোধ তৈরি হলেই মেয়েদের মূল্যায়ন হবে।

ইউএনএফপিএর কর্মকর্তা হুমায়রা ফারহানাজ বলেন, একজন মেয়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমতার অধিকার রয়েছে। বাল্যবিবাহ হওয়ার পর মেয়েটির ওপর দ্রুত সন্তান নেওয়ার তাগিদ থাকে পরিবারের লোকজনের। এতে মেয়েটি স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ে। তিনি বলেন, দেশে নারীদের ক্ষমতায়নে বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থা শক্তিশালী থাকলেও এর বাস্তবায়ন পিছিয়ে।

কিশোরীদের অধিকার আদায় করে দৃষ্টান্ত স্থাপনের আহ্বান জানিয়ে নারীপক্ষের কামরুন নাহার বলেন, যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলোর কারণেও অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকেরা বাল্যবিবাহের দিকে ঝুঁকে থাকেন। অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও তা উত্তরণের পথও রয়েছে। এসব সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে কিশোরীদের অন্যের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। অকপটে কথা বলার মন্ত্র ধারণ করতে হবে।

কেয়ার বাংলাদেশের কর্মকর্তা রওনক জাহান বলেন, অনেক অভিভাবক জেন্ডার সংবেদনশীলতার বিষয়টি বুঝলেও কাজে তার প্রতিফলন ঘটান না। এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে বাল্যবিবাহ বন্ধ হবে না। দ্রুত বিয়ে না দিলে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা ঘটতে পারে বলে শঙ্কায় থাকেন অনেক অভিভাবক। তাই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে সমাধান খোঁজেন। আবার বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েটিকে প্রথম বছরেই সন্তান জন্ম দিয়ে তাঁর প্রজনন সক্ষমতা জানান দিতে হয়। কিশোরীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমরা যে স্বপ্ন দেখছ, তা দেখতে থাকো। স্বপ্ন পূরণে সোচ্চার হও।’