স্বপ্ন ভেঙেছে মফিদুলের মতো অনেক ব্যবসায়ীর

ক্রেতা নেই কালীগঞ্জের গার্মেন্টসপল্লিতে। গতকাল রোববার দুপুরে তোলা ছবি।
ছবি: প্রথম আলো

খুলনার মফিদুল ইসলাম দীর্ঘসময় মালয়েশিয়ায় প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বছর পাঁচেক আগে কাজ হারিয়ে বিপাকে পড়ে যান। অনেক চেষ্টা–তদবির করেও আর কাজ ফিরে পাননি মফিদুল। পরে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। দেশে ফেরার পর বড় ভাইয়ের পরামর্শে ঢাকার কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জে একটি দোকান ভাড়া নেন। বিদেশে কাজ করে তাঁর যে সঞ্চয় ছিল, তার পুরোটাই ব্যবসার কাজে লাগান। প্রথম দুই বছর ভালোই ব্যবসা করলেন। নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন, দিনে দিনে তাঁর ব্যবসাটা অনেক বড় হবে। কারখানায় আরও বেশি উৎপাদন করতে পারবেন। বিক্রি বেশি হবে।

তবে দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর বেচাকেনা একেবার কমে যাওয়ায় খুলনার উদ্যোক্তা মফিদুলের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। মফিদুল বলছেন, করোনায় গত এক বছরে তাঁর লোকসানের পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ টাকা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাংকঋণ আরও ৩০ লাখ টাকা।

কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ গার্মেন্টসপল্লিতে বেচাকেনা জমে ওঠে শবে কদর থেকে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত। তবে করোনায় কঠোর বিধিনিষেধে টানা ৬৬ দিন বন্ধ ছিল সরকারি-বেসরকারি অফিসসহ নানা প্রতিষ্ঠান। তখন বন্ধ ছিল দেশের সব দোকানপাট। ঈদের আগে দোকানপাট বন্ধ থাকায় গত বছরও বেচাকেনা করতে পারেননি মফিদুল। পরে দোকানপাট খুললেও বেচাকেনা আর জমে ওঠেনি। আশা করেছিলেন, এবার ঈদের আগে বেচাকেনা ভালো হবে। তাই ব্যাংক থেকে, পরিচিত আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নেন। সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করে নতুন নতুন ভালো শার্ট বানান কারখানায়। কিন্তু মফিদুল যা ভেবেছিলেন, পরিস্থিতি তার উল্টো হয়ে যায়।

করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ৫ এপ্রিল থেকে কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হয়। সেই থেকে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ। এর মধ্যে কিছুদিন দুই দফা দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। গত ২৫ এপ্রিল থেকে আবার দোকানপাট খুলেছে। তবে কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ গার্মেন্টসপল্লিতে বেচাকেনা জমেনি।

কালীগঞ্জ গার্মেন্টসপল্লির ব্যবসায়ী মফিদুল ইসলাম।
ছবি: প্রথম আলো

মফিদুল বলেন, ‘কখনো ভাবিনি, আমার এমন অবস্থা হবে। যে বেচাকেনা হয়েছে, তা একেবারই সামান্য। বিক্রি কমেছে ৮০ গুণ। এভাবে চললে আর বেশি দিন আমার পক্ষে ব্যবসা করা সম্ভব হবে না।’ একা মফিদুল নন, কালীগঞ্জের গার্মেন্টসপল্লির কয়েক শ ব্যবসায়ীর একই অবস্থা।

কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকানমালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মুসলিম ঢালী প্রথম আলোকে বলেন, কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টসপল্লিতে দোকান আছে ১৫ হাজার। পাঁচ হাজার কারখানা আছে। তবে এ করোনার ধাক্কায় তিন হাজারের মতো কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আর দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে তিন থেকে চার হাজার। এক বছর ব্যবসা করতে না পারলেও কর্মচারীর বেতন দিতে হচ্ছে। ব্যাংকঋণের সুদ দিতে হচ্ছে।

কালীগঞ্জ গার্মেন্টসপল্লির একটি দোকানে ক্রেতা না থাকায় অলস সময় কাটাচ্ছেন কর্মচারীরা।
ছবি: প্রথম আলো

তিনি আরও বলেন, ‘আমার পরিচিত এমন অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যার কারখানায় ২০০ শ্রমিক কাজ করতেন। তারা এখন ফুটপাতের ব্যবসায়ী হয়ে গেছেন। অনেকে দেউলিয়া হয়ে গেছেন।’

ব্যবসা ছেড়েছেন অনেকে

কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টসপল্লির বেশির ভাগ ব্যবসায়ী পুরান ঢাকার ইসলামপুর থেকে কাপড় কেনেন। পরে সেই কাপড় নিয়ে যাওয়া হয় কারখানায়। কারখানায় তৈরি হয় শার্ট, প্যান্টসহ পরিধেয় নানা পোশাক।

মফিদুল জানান, তাঁর মতো এবার অনেক ব্যবসায়ী ইসলামপুর থেকে বাকিতে কাপড় কেনেন। ঈদের আগে বেচাকেনা করে সেই টাকা পরিশোধ করেন। করোনার কারণে ব৵বসা না হওয়ায় তাঁরা এবার কেউই ইসলামপুরের ব্যবসায়ীদের টাকা পরিশোধ করতে পারেননি।

কালীগঞ্জ গার্মেন্টসপল্লির ব্যবসায়ীরা বলছেন, কালীগঞ্জের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কাপড়চোপড় কিনে নিয়ে যান দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পোশাক ব্যবসায়ীরা। কালীগঞ্জে দোকান আছে ১৫ হাজার। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক পোশাক ব্যবসায়ী কালীগঞ্জের দোকান থেকে বাকিতে পোশাকসামগ্রী নিয়ে যান। বিক্রি শেষে আবার তা পরিশোধ করে দেন। এভাবেই বছরের পর বছর ব্যবসা চলছে।

তবে করোনায় পাল্টে গেছে ব্যবসার ধরন। ইসলামপুরের ব্যবসায়ীরা বাকিতে কাপড় বিক্রি বন্ধ করেছেন। এতে কালীগঞ্জের গার্মেন্টসপল্লির ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন। নগদ টাকায় ইসলামপুর থেকে কাপড় কিনতে হয়েছে। আবার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক দোকানি কালীগঞ্জের ব্যবসায়ীদের বাকির টাকা শোধ করেনি। একদিকে ঈদের আগে বেচাকেনা নেই। আবার বাকির টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।

কালীগঞ্জ গার্মেন্টসপল্লির বেশির ভাগ ব্যবসায়ী বলছেন, তাঁদের বিক্রি একেবারই কম। ফলে আয়ও কমে গেছে। আয় কমলেও ব্যয় কিন্তু এক টাকাও কমেনি। মাস গেলে দোকান ভাড়া গুনতে হচ্ছে, কর্মচারীর বেতন দিতে হচ্ছে, কারখানার ভাড়া দিতে হচ্ছে, দিতে হচ্ছে গুদামভাড়াও। আর মাথার ওপর বড় বোঝা ব্যাংকঋণ। মাস গেলে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়ছে। গত এক বছরে আয় না থাকলেও সুদের টাকা কিন্তু পরিশোধ করতে হচ্ছে।

কালীগঞ্জের ফাইভ ব্রাদার্স গার্মেন্টের মালিক আলাউদ্দিন আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পক্ষে আর লোকসান দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। এক বছরে আমার লোকসান ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা। বেচাকেনা নেই, কিন্তু মাস গেলে ব্যাংকঋণের সুদের টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। আয় না থাকলে কোত্থেকে ব্যাংকঋণ শোধ দেব? কোত্থেকে কর্মচারীর বেতন দেব?’

কালীগঞ্জ গার্মেন্টসপল্লি ব্যবসায়ী নেতা মুসলিম ঢালী।
ছবি: প্রথম আলো

গতকাল রোববার দুপুরের পর বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত কেরানীগঞ্জের গার্মেন্টসপল্লির দোকান ঘুরে দেখা গেল, ক্রেতা নেই। অলস সময় পার করছেন দোকানের কর্মচারীরা।

কালীগঞ্জের দোকান কর্মচারী মোহাম্মদ ইমন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শবে বরাতের পর ঈদের আগপর্যন্ত আমাদের এখানে বেচাকেনা জমে ওঠে। তবে এবার বেচাকেনা সেভাবে হয়নি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা পাইকারি ব্যবসায়ী ও ক্রেতা সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাই। কিন্তু এবার আমার ক্রেতা নেই। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, আমরা বসে বসে মাছি মারছি।’

কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকানমালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মুসলিম ঢালী প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনায় গত এক বছরের বেশি সময়ে আমরা তিনটি ঈদ পেলাম। আমরা কিন্তু সেভাবে ব্যবসা করতে পারিনি।’