স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার সকালটিতে

২৫ জুন ২০২২ সকাল সাতটায় গীতিকার কবির বকুল, শিল্পী কিশোর দাসের সঙ্গে একই গাড়িতে ধানমন্ডি ছাড়ছি। ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক বাড়িটির পাশ দিয়েই গাড়ি ছুটছে। আমরা যাচ্ছি মাওয়া। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে। আমরা ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের দিকে শ্রদ্ধাভরে তাকাই। ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’—বঙ্গবন্ধুর এই কথাটা বারবার করে মনে করার দিন তো আজ। কারণ, আমরা জানি, এই সেতুর নকশা হয়ে যাওয়ার পর অর্থায়নের প্রক্রিয়া শুরু হলে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে পিছিয়ে যায়। অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও ঋণ দিতে রাজি হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নেন, পদ্মা সেতু হবে বাংলাদেশের মানুষের টাকায়। নিজস্ব অর্থায়নে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ তখন বলেছিলেন, এটা সম্ভব নয়। আজ সেটা আর সম্ভাবনা নয়, স্বপ্ন নয়, জেদও নয়, বাস্তবতা।

গাড়ি ছুটছে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের দিকে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস পেরোচ্ছি। আমার শিক্ষকদের কথাও আজকে মনে পড়ছে। জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার পদ্মা সেতু বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান ছিলেন। দুই বছর আগে তিনি হঠাৎই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। আমার আরেক শিক্ষক শামীম জেড বসুনিয়া এই প্যানেলের প্রধান। এ এম এম সফিউল্লাহ স্যার প্যানেলে ছিলেন। তিনিও আজ বেঁচে নেই। নেই আলমগীর মুজিবুল হক স্যার। আছেন আইনুন নিশাত, এম ফিরোজ আহমেদ, খান মাহমুদ আমানত, হোসেন মো. শাহিন স্যাররা। সান ফ্রান্সিসকো থেকে যুক্ত আছেন আউয়াল স্যার। সবার ক্লাস আমি পেয়েছি। ভাবতে গর্ব বোধ হয়। আছেন চারজন বিদেশি। সচিব থেকে শুরু করে সেতু বিভাগ কিংবা প্রকল্প পরিচালক, বাঙালি কর্মকর্তা আর ইঞ্জিনিয়াররা সম্পন্ন করলেন এক অসম্ভবপ্রায় প্রকল্প। পদ্মা সেতুর বিশ্ব রেকর্ড চারটি—১. প্রকল্পে ৩ মিটার ব্যাসের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্যের স্টিল পাইলের ব্যবহার করা হয়েছে, ২. সবচেয়ে লম্বা স্টিলের স্প্যান বসানো হয়েছে, যার দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার, ৩. সর্বোচ্চ ক্ষমতার বিশেষ ধরনের বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে, যার নাম ‘ডাবল কারভেচার ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’। ৪. নদীশাসন কাজের একক সর্ববৃহৎ দরপত্র।

তিনটি বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহারের বেলায় পদ্মা সেতু পৃথিবীতে প্রথম। পদ্মা সেতুর নির্মাণপ্রযুক্তিতে সাতটি বিষয় আছে, যা বাংলাদেশে প্রথম। এমন একটা দুরূহ কাজ পৃথিবীর ২০টি দেশের বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় নানা সংস্থা আর হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে সুসম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ।

পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক তো বিশ্বমানের। সকাল ৭টা ৪০ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম মাওয়ার অনুষ্ঠান এলাকায়। সাদা রঙের বিশাল তাঁবুর নিচে অনুষ্ঠান শুরু হবে সকাল ১০টায়। করবটা কী? দেখা পেয়ে গেলাম পরিচিত শিল্পী-সাহিত্যিকদের। শিল্পী ফেরদৌস, রিয়াজ, নিপুণ, মেহের আফরোজ শাওন, শমী কায়সার, আফসানা মিমি, আবৃত্তিশিল্পী আশরাফুল আলম, আহকাম উল্লাহ, কবি তারিক সুজাত প্রমুখের। সবার চোখে-মুখেই একটা জয়ের আভা; বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছে—আমরা পারি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একাগ্রতা আর দূরদর্শিতার কথা বলছেন সবাই।

সকাল ১০টায় এলেন প্রধানমন্ত্রী। কবির বকুলের লেখা সংগীত প্রচারিত হলো। কিশোর দাসের সুরে সাবিনা ইয়াসমিন, রফিকুল আলম, কুমার বিশ্বজিৎ, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, মমতাজ, বাপ্পা মজুমদার, কনা, ইমরান, নিশিতা আর কিশোরের গাওয়া গানের ভিডিও চিত্র উপভোগ করলাম আমরা। পাশে বসা কবির বকুল আর কিশোরের জন্য গর্বও অনুভব করলাম।

দেখানো হলো পদ্মা সেতুর ওপরে নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র। সভাপতিত্ব করছেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম কথা বলতে উঠে খানিকক্ষণ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে রইলেন। এত দিনের সঞ্চিত আবেগ বুঝি একসঙ্গে বেরোতে চাইছে। সচিব ও মন্ত্রী দুজনের বক্তৃতাতেই একটা কথা বারবার করে উঠল। পদ্মার দুই পারের মানুষদের কথা। তাঁরা তাঁদের ভিটেমাটি দিয়েছেন পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য; কিন্তু তাঁরা গৌরবের সঙ্গে বলেছেন, আমাদের ভিটেমাটিতে তো পদ্মা সেতু হচ্ছে।

সাদা জমিনে লাল কাজ করা জামদানি শাড়ি পরা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সংযত। তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না যে সম্পূর্ণ অকারণে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না–থাকা তাঁর পরিবারের সদস্যদের ওপর কালিমা লেপনের অপচেষ্টা হয়েছিল। তখনকার উপদেষ্টা, সচিব, মন্ত্রীকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল। কানাডার আদালতে সেই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বললেন, আজ কোনো অনুযোগ নয়, অভিযোগ নয়, শুধু বলব, তাদেরও আত্মবিশ্বাস বাড়বে, তারাও ভাবতে পারবে যে আমরাও পারি। তিনি বলেন, মানুষের শক্তি হলো সবচেয়ে বড় শক্তি। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা থেকে তিনি পড়ে শোনান, ‘সাবাস বাংলাদেশ এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়—/ জ্বলে–পুড়ে–মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।’

শেখ হাসিনা জানালেন, ‘বিদেশি সাংবাদিক জাতির পিতাকে বলেছিল, আপনার তো কোনো সম্পদ নেই, কীভাবে এই দেশ গড়বেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমার মাটি আছে, আমার মানুষ আছে, তা দিয়েই আমরা বাংলাদেশকে গড়ে তুলব।”’

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শেষে হলো ডাকটিকিট এবং বিশেষ টাকার উন্মোচন করে। চলল সংশ্লিষ্টদের নিয়ে মঞ্চে ফটোসেশন। তারপর প্রধানমন্ত্রী গেলেন উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করতে। সঙ্গে তাঁর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ। তাঁরা ছবি তুললেন, সেলফি তুললেন, সেতুতে হাঁটলেন, ভিডিও কলে প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বললেন। পদ্মার দুই পারের জনতরঙ্গের আনন্দকল্লোল তখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচকানাচে।

পদ্মা সেতু চালু হলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে কতটা? অর্থনীতিবিদদের হিসাব আমরা জানি। কিন্তু আমরা তো জানি, যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার আগে আমাদের নিজের গ্রাম গাইবান্ধার সাতানাবালুয়াতে কার্তিক মাসে আমাদের প্রতিবেশীরা না খেয়ে থাকত! আপনারা কি আমার লেখা নাল পিরান নাটক দেখেছেন? দুই ছোট্ট ছেলে সবুজ আর মুকুল চুলার ধারে মায়ের কাছে বসে আছে, হাঁড়িতে বলক উঠছে, তারা খুশিতে বলে উঠছে, ‘মা, আজকা ভাত খামো? ‘কত দিন পরে তারা ভাত খাবে!’ এগুলো বানানো গল্প নয়, আমার নিজের দেখা রংপুর অঞ্চলের মঙ্গার সময়ের বাস্তবতা। বঙ্গবন্ধু সেতু হলো। এখন আর আমাদের গ্রামে আকাল আসে না, মঙ্গা হয় না। কারণ, কলার চাষ হয়, সবজির চাষ হয়, মাছের চাষ হয়, ভুট্টার চাষ হয় উত্তরাঞ্চলে; সেসব সহজেই যমুনা পার হয়ে এপারে চলে আসতে পারে। রংপুরের শ্রমিকেরাও কাজ করতে চলে আসেন গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জে। আপনারা হিসাব করতে থাকুন কত ভাগ প্রবৃদ্ধি দিয়েছে বঙ্গবন্ধু সেতু, আমি জানি, আমার পড়শির খালি পেটে এখন দুই বেলা ভাত জোটে! এর মূল্য তাদের কাছে অপরিসীম, এটা আমরা খুব ভালো করে বুঝি।

পদ্মা সেতুও অনেক নিরন্ন মুখে ভাত জোটাবে, অনেক বিষণ্ন মুখে হাসি ফোটাবে।

পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ করে ফিরছি। কবির বকুল তখন ফেসবুকে পদ্মা সেতুর গান বাজাচ্ছেন: ‘মাথা নোয়াবার নয়, বাঙালি যেহেতু; বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন দেশ, তুমি দিলে পদ্মা সেতু’।

ক্রিকেটে বলা হয়, জয়ের চেয়ে বড় কোনো টনিক নেই। একটা জয় এলেই আরও জয় আসতে থাকে।

আর্থিক বাধা, ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জ, মহামারি, ষড়যন্ত্র—নানা রকমের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এক বিশাল জয় এনে দিয়েছে পদ্মা সেতু। এই জয় আরও অনেক ক্ষেত্রে আমাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে, নতুন নতুন জয়ের পথ তৈরি করবে।

আর সেই জয়ের নায়ক বাংলার মানুষ, সেই জয়ের সঞ্জীবনী আছে বাংলার মাটিতেই।