স্বাভাবিক জীবন পেতে পারে হিজড়ারাও
একজন হিজড়া অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নারী বা পুরুষ হিসেবে সাধারণ জীবন যাপন করতে পারেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এ ধরনের অস্ত্রোপচারের সুযোগ আছে।
চিকিৎসকেরা বলছেন, যৌনাঙ্গে অসংগতি (লিঙ্গ নির্ধারণজনিত জটিলতা) ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকের উচিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। জন্মের ছয় মাস পর থেকে বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত চিকিৎসা করলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায়। অসংগতি অল্প হলে একটি অস্ত্রোপচারেই শিশু স্বাভাবিক জীবন পেতে পারে। কখনো কখনো কয়েক ধাপে অস্ত্রোপচার করতে হতে পারে।
বাংলাদেশে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে যৌনাঙ্গে অসংগতির চিকিৎসা চলছে, কিন্তু প্রচার নেই। গত চার বছরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাত্র ১৮টি অস্ত্রোপচার হয়েছে। যদিও এই হাসপাতালে নামমাত্র মূল্যে বা বিনা মূল্যে চিকিৎসার সুযোগ আছে।
গত বছরের ১১ নভেম্বর সরকার হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে দেশে তাদের সংখ্যা কত, তার সরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই। হিজড়া সম্প্রদায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ সংখ্যা কয়েক লাখ।
প্রতিবেদনটি তৈরির সময় মিরপুর শাহ আলী মাজারসংলগ্ন এলাকা, কারওয়ান বাজার ও সাভারে ১৬, ৩৭ ও ৭০ এই তিন বয়সের তিনজন হিজড়ার সঙ্গে কথা হয়। প্রত্যেকের জীবনের গল্প একই। নারী বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেতে শুরু করার পরপরই এঁদের ওপর যৌন নির্যাতন চালায় নিকটাত্মীয়রা। বাড়িতেও এঁরা নিগ্রহের শিকার হন। ১৬ বছর বয়সীটি কথার ফাঁকেই এক হাতে ভাইয়ের ছ্যাঁকার দাগ দেখায়। ৩৭ বছর বয়সী একজন বলছিলেন, তিনি তাঁর ভাইদের কাছে ওয়াদা করেছেন আর কখনো বাড়িমুখো হবেন না। প্রত্যেকে দীক্ষা নিয়ে হিজড়া সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েছেন। চাঁদা উঠিয়ে সিংহভাগ দলনেতার হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন। যৌনকর্ম অন্যতম আয়ের উৎস হওয়ায় ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে যৌনাঙ্গ কেটে ফেলতে হয় বেশির ভাগ হিজড়াকে। কেউ কেউ এতে মারাও যান।
হিজড়া কারা, চিকিৎসা কী: একটি বেসরকারি হাসপাতালে এই মুহূর্তে চিকিৎসাধীন একজন কিশোর প্রথম আলোকে বলে, ‘আমার বাবা-মা আমাকে মেয়ে হিসেবে বড় করছিলেন। হাইস্কুলে সবার যখন মাসিক হতে শুরু করল, আমার তখন গলা ভেঙে ছেলেদের মতো হতে শুরু করেছে।’
ঢাকায় একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর একজন ছাত্র জানায়, বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানোর পর থেকে তার দেহের গঠন ক্রমশ নারীদের মতো হতে শুরু করে।
জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক কাজী রফিকুল আবেদিন বলছিলেন, মাতৃগর্ভে ভ্রূণের বয়স আট সপ্তাহ হওয়া পর্যন্ত জরায়ুতে পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গ নির্ধারক দুটি নালিই সামান্তরালভাবে থাকে। সন্তানটি যদি মেয়ে হয়, তাহলে পুরুষ লিঙ্গ নির্ধারক নালিটি প্রাকৃতিকভাবে অপসৃত হয়। ছেলে হলে ঘটে ঠিক তার উল্টোটা। কিন্তু হিজড়াদের শরীরে দুটি নালিই থেকে যায়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হিজড়াদের ডিম্বাশয় ও শুক্রাশয় থাকে, একই সঙ্গে জরায়ু ও পুরুষদের যৌনাঙ্গ থাকে। তবে কোনোটিই পুরোপুরি বিকশিত হতে পারে না। ডিম্বাশয় থেকে নারীদেহের হরমোন ইস্ট্রোজেন এবং শুক্রাশয় থেকে পুরুষদেহে থাকা এন্ড্রাজেন নির্গত হয়। এতে করে কারও কারও স্তন তৈরি হয়, কারও কারও দাড়ি-গোঁফও হতে পারে।
চিকিৎসকেরা বলেন, বাংলাদেশে শিশুর সুপ্ত পরিচয় জানতে প্রথমেই চিকিৎসকেরা ক্রোমোজোমাল অ্যানালাইসিস করেন। শিশুটির মধ্যে যে লিঙ্গের প্রভাব বেশি, তাতেই তাকে রূপান্তর করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও বারডেম হাসপাতালে এ ধরনের পরীক্ষা হয়ে থাকে। এরপর আরও কয়েকটি সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকেরা যান অস্ত্রোপচারে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান আশরাফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, গোটা বিশ্বেই হিজড়াদের মধ্যে নারী বৈশিষ্ট্য বেশি। বাংলাদেশেও তাই। পুরুষ যৌনাঙ্গ অপসারণ করে যোনিপথ তৈরি করে দেওয়া বেশ সহজ। ছয় মাস বয়স থেকেই চিকিৎসা শুরু করা যায়। অস্ত্রোপচারের পর স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়ে থাকে। একটু বড়বেলায় প্রয়োজনীয় হরমোনের ঘাটতি মেটাতে বাইরে থেকে হরমোন প্রয়োগ করা হয়। পুরুষ যৌনাঙ্গও তৈরি করে দেওয়া সম্ভব।
বদলে গেছে জীবন: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর আগে পুরো মুখ পর্দায় ঢেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিল এক কিশোরী। পর্দা সরাতে দেখা গেল দাড়ি-গোঁফ উঠছে তার, যৌনাঙ্গেও অসংগতি। অস্ত্রোপচারের পর ভালো হয়েছে সে। ইদানীং বিয়ে করে সংসার পেতেছে।
কাজী রফিকুল আবেদীন বেশ অনেক বছর আগে একই পরিবারের তিন ভাইয়ের অস্ত্রোপচার করেছিলেন। বদলে গেছে দুটি ভাইয়ের জীবন। এক ভাই হাসপাতালে চাকরি করছেন। বিয়ে করেছেন, সন্তান দত্তক নিয়েছেন। ছোটোটি কৈশোরেই চলে গিয়েছিল হিজড়াদের ডেরায়, সে আর ফেরেনি। নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে চট্টগ্রামের নয় বছর বয়সী এক শিশু। পার্থক্য এটুকুই, একটা সময় ছেলেদের স্কুলে যেত, সে এখন যাচ্ছে মেয়েদের স্কুলে।
তবে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অনেকে সেবা নিচ্ছে না। আশরাফুল হক জানান, বরিশাল থেকে ১৫ বছর বয়সী একজন এসেছিল। বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানোর পর নারীদের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। তবে বহু বোঝানোর পরও পরিবারটি তাকে মেয়েতে রূপান্তরিত হতে দেয়নি।