স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চ্যালেঞ্জ

বন্যায় ভেঙে যাওয়া ঘর মেরামতের চেষ্টা করছেন সুরেতুন বেগম। গতকাল সুনামগঞ্জ শহরের পাঠানবাড়ি এলাকায়
ছবি: আনিস মাহমুদ

এপ্রিলের শুরুতে আগাম বন্যায় মাঠের ফসল হারিয়ে দুর্দশার শুরু। মে মাসের মাঝামাঝি বন্যায় ঘরেও বিপর্যয়। জুনের মাঝামাঝি বন্যায় ভেসে গেছে সবই। এখন বন্যার পানি অনেকটাই নেমে গেছে। ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন বিপর্যস্ত মানুষ। এবার ঘর মেরামত আর জীবন-জীবিকায় ফেরার উপায় খুঁজছেন তাঁরা।

সুনামগঞ্জের বানভাসি মানুষ বলছেন, তাঁদের বিপদে সরকারের পাশাপাশি সারা দেশের মানুষ ত্রাণ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু ত্রাণসামগ্রী দিয়ে তো জীবন চলবে না। এখন পুনর্বাসনের জন্য দরকার আর্থিক সহায়তা।

শুধু ঘরবাড়ি নয়, মাঠের ফসল থেকে মাছ, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশুর খামার—সবই হারিয়েছেন হাওরের মানুষ। অনেকের ব্যাংকে ঋণ আছে। সরকারি ঋণ, প্রণোদনা না পেলে এসব চাষি ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না।

ব্যাংক থেকে ছয় লাখ টাকা ঋণ নিয়ে সদর উপজেলার মনোহরপুরে মাছ ও কোয়েল পাখির খামার করেছিলেন মাহবুবুল আলম। দোকানে দেনা আছে সাড়ে চার লাখ টাকা। তিনি বলেন, ‘১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ব্যাংক তাগাদা দিচ্ছে ঋণের কিস্তি পরিশোধের।’

সুনামগঞ্জের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, বন্যায় সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলায় প্রায় ৩০ লাখ মানুষ, ৪৫ হাজার ২৮৮টি ঘর ও ২ হাজার ২০০ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২৫ হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। আট হাজারের বেশি একর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। গোলার ধান ভেসে গেছে। প্রায় দুই হাজার একর জমির সবজি ডুবে গেছে। গবাদিপশু মারা গেছে ১ হাজার ৭০০টি। আর হাঁস-মুরগি হারিয়ে গেছে ১ লাখ ২৬ হাজার।

প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণ কম

সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে এগিয়ে এসেছেন অনেকে। কিন্তু ত্রাণ বিতরণের শুরুতেই সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় বেশির ভাগ ত্রাণ সুনামগঞ্জের শহর ও আশপাশের এলাকায় বিতরণ হতে থাকে।

জেলা প্রশাসনের হিসাব বলছে, ৫ জুলাই পর্যন্ত বেসরকারি বিভিন্ন উৎস থেকে প্রায় তিন লাখ প্যাকেট ত্রাণ এসেছে। প্রথম আলো ট্রাস্টের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উপজেলায় ৮০০ পরিবারের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর পক্ষ থেকেও ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। সরকারি ত্রাণ বিতরণও চলছে।

তবে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে কারও কারও অভিযোগ আছে। তাঁরা বলছেন, কেউ কেউ বারবার ত্রাণ পাচ্ছেন। আর কেউ কম পাচ্ছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সুনামগঞ্জ জেলা সভাপতি হোসেন তওফিক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ত্রাণ কার্যক্রমে এখনো সমন্বয়ের অভাব আছে। প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো ত্রাণ যাচ্ছে কম।

পুনর্বাসন কার্যক্রমে ধীরগতি

শান্তিগঞ্জ উপজেলার দেখার হাওরের মানিকপুর গ্রামের আলিফ নূরের ঘর পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ত্রাণ আসছে, খেতেও পারছেন। কিন্তু অর্থের অভাবে থাকার ঘর ঠিক করতে পারছেন না।

জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, মানুষের ঘরবাড়ি মেরামত বা নতুন করে তুলতে সরকারের পক্ষ থেকে পাঁচ কোটি টাকার পুনর্বাসন সহায়তা এসেছে।

জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ধাপে ধাপে সব ক্ষতিগ্রস্তকে পুনর্বাসন করা হবে। প্রথমে অতিদরিদ্রদের দেওয়া হচ্ছে। কৃষকদের মধ্যে সার, বীজ, কীটনাশক বিতরণ করা হবে। মাছ, মুরগি, গবাদিপশুর খামারিদের প্রণোদনা দেওয়া হবে।

দ্রুত ঘরে ও কাজে ফেরার তাগিদ

ত্রাণ পেয়ে প্রাথমিক বিপদ কাটিয়ে উঠেছেন হাওরের মানুষ। এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান তাঁরা। শান্তিগঞ্জ উপজেলার শরীয়তপুর গ্রামের কাঠমিস্ত্রি সুরুজ আলী বলেন, বন্যার কারণে সব কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ঘরবাড়ির কাজ শুরু হলে স্বস্তি পাবেন তাঁরাও।

বন্যায় মানুষের পেশাও হুমকির মুখে পড়েছে। দোকান ভেসে যাওয়ায় জুতার কাজ করতে পারছে না মুচি সম্প্রদায়। নৌকা হারিয়ে তাঁবুতে থাকা বেদেরাও অসহায়। কৃষক ও খামারিরা আছেন দুশ্চিন্তায়। সরকারি প্রণোদনা বা বিশেষ ঋণের আশায় আছেন তাঁরা।

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সফিয়ান প্রথম আলোকে বলেন, এখন জরুরি হলো পুনর্বাসন। এটিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে জরুরি কার্যক্রম শুরু করতে হবে।