স্বামীর বাড়িতে না গিয়ে গেলেন আশ্রয়কেন্দ্রে

বিএনডব্লিউএলএর নোয়াখালীর আইনজীবী কল্পনা রানী দাশ ওই নারীর মামলায় আইনি সহায়তা দিচ্ছেন। তাঁর সঙ্গেই ওই নারী ঢাকা পর্যন্ত এসেছিলেন। বিএনডব্লিউএলএর ঢাকার কার্যালয়ে ওই নারীর হাতটি ধরে সাহস দিচ্ছেন তিনি
ছবি: প্রথম আলো

‘এখন নতুন করে জীবন পাইছি। একসময় টেনশন করতাম। লোকের সামনে কেমনে মুখ দেখাইব, তা ভাবতাম। আত্মহত্যা করতেও ইচ্ছা করত। কিন্তু করব না। শেষ দেখব। যত দিন বাঁচি থাকব, যুদ্ধ করি বাঁচব।’ দৃঢ়ভাবে কথাগুলো বললেন বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নির্যাতনের শিকার ওই নারী।

রাজধানীতে এই নারীর সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির (বিএনডব্লিউএলএ)  কার্যালয়ে বসে কথা হয়। ভিডিও ভাইরাল হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বললেন, আগে যেভাবে তিনি সমাজে চলাফেরা করতে পারতেন, তা আর তাঁর পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে না। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকে মানুষ তাঁকে নিয়ে অতি–উৎসাহী হওয়ায় তিনি বাবা বা স্বামীর বাড়িতে থাকতে পারেননি। ঘটনার পর থেকে এত দিন ছিলেন বেগমগঞ্জ থানার হেফাজতে একটি স্টাফ কোয়ার্টারে। শনিবার থেকে তিনি বিএনডব্লিউএলএর একটি আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা শুরু করেছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার আগে শনিবার সকালে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।

নোয়াখালীতে এই নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় গত বছরের ৪ অক্টোবর। বিষয়টি প্রশাসন ও গণমাধ্যমকর্মীদের নজরে এলে সবাই নড়েচড়ে বসেন। নির্যাতনের শিকার নারীকে উদ্ধার করা হয়। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর বেগমগঞ্জ উপজেলার একটি ইউনিয়নে দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলুসহ ১৪ থেকে ১৫ জনের একদল দুর্বৃত্ত জোর করে ওই নারীর ঘরে ঢুকে ‘বিবস্ত্র’ করে ধর্ষণচেষ্টা এবং পুরো ঘটনাটির ভিডিও চিত্র ধারণ করে।

তখন ওই নারী অথবা তাঁর পরিবারের কেউ থানায় কোনো অভিযোগ করেননি। ওই নারী পুনরায় অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ৩২ দিন পর গত ৪ অক্টোবর অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন।
এর আগে প্রথম দফায় ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর ওই নারীকে ধর্ষণ করেন দেলোয়ার। এরপর গত বছরের ৭ এপ্রিল আবু কালামের সহযোগিতায় দ্বিতীয় দফায় তাঁকে ধর্ষণ করা হয়।

ওই নারী বললেন, ‘ওরা ভয় দেখাইত, কাউরে বললে জিন্দা মাইরা ফালাইব, কোনো প্রমাণও রাখব না বলত।’

নির্যাতনের ওই ভিডিওতে দুর্বৃত্তদের ‘আব্বা’ ডেকেও রেহাই পাননি ওই নারী। বিএনডব্লিউএলএর কার্যালয়ে বসে তিনি বললেন, ‘একজনকে কাকা ডাকতাম, মান্য করতাম, সে–ও নোংরা কাজ করছে। তারে এখনো ধরা হয় নাই। আমি বিচার চাই, অপরাধীদের ফাঁসি চাই। অনেক লোক ধরার বাকি, কেন ধরছে না আমি জানি না।’
এই নারী জানালেন, তিনি বেগমগঞ্জ থানা হেফাজতে ভালো এবং নিরাপদেই ছিলেন।

তবে হুট করেই তাঁকে তাঁর বাবা ও স্বামীর জিম্মায় দিয়ে স্বামীর বাড়িতে পাঠানোর উদ্যোগ নেয় থানা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এ উদ্যোগে ভরসা পাচ্ছিলেন না তিনি। শুরু থেকেই তাঁকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিতে পাশে দাঁড়ায় বিএনডব্লিউএলএসহ বিভিন্ন ব্যক্তি। সে সূত্রেই ওই নারী মুঠোফোনে থানা হেফাজত থেকে স্বামীর বাড়ি যেতে চান না বলে জানালে বিএনডব্লিউএলএ আইনি প্রক্রিয়ায় ওই নারীকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়।

বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুজ্জামান শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকে ওই নারী থানার হেফাজতে ছিলেন। তাঁর বাড়িও পুলিশের নজরদারির মধ্যেই ছিল। থানার নিজস্ব সেফ কাস্টোডি নেই। এ ছাড়া চারপাশের সামাজিক অস্থিরতাও কমেছে। তাই পুলিশ প্রহরায় তাঁকে স্বামীর বাড়িতে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে ওই নারী রাজি হননি।

বিএনডব্লিউএলএর সভাপতি আইনজীবী সালমা আলী প্রথম আলোকে বলেন, এত দিন এই নারী নিরাপদে ছিলেন। এখন যখন তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তখন আইনি প্রক্রিয়ায় তাঁকে সেখানে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ওই নারী জানালেন, দুর্বৃত্ত সবাই ওই নারীর বাবার বাড়ির আশপাশের লোকজন। কম বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। মেয়ের ঘরের নাতিও আছে, বয়স ১৬। প্রায় ১৩ বছর আগে স্বামী দুই সন্তান ফেলে আরেকজনকে বিয়ে করে আলাদা হয়ে যান। তখন তিনি বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন।

গত বছর ওই নারীর স্বামী আবার ফিরে আসেন। বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনার দিনও স্বামী ঘরেই ছিলেন। এই নারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার আগে থেকেই ওরা অনেক জ্বালাইছে। আমার নাতি আছে, তারপরও ওরা খারাপ প্রস্তাব দিত। ওদের মধ্যে অনেকের বয়স আর আমার ছেলের বয়স একই ছিল। এই সব বইলাও রেহাই পাই নাই।’ স্বামী আবার আসা-যাওয়া শুরু করলে এ ঘটনাকেই ইস্যু করে দুর্বৃত্তরা ওই নারীকে নির্যাতন করে।

ওই নারী স্বামীর আচরণেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘হাঁস–মুরগি মারি ফেললেও স্বামী প্রতিবাদ করত। আর এত্ত বড় ঘটনা ঘটার পর আজ পর্যন্ত কোনো প্রতিবাদ করে নাই।’

ওই নারী বাদী হয়ে বেগমগঞ্জ মডেল থানায় নির্যাতন ও ধর্ষণচেষ্টা, ধর্ষণ এবং ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেন। গত ৭ অক্টোবর মামলাগুলোর তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পিবিআইর প্রধান বনজ কুমার মজুমদার প্রথম আলোকে বললেন, নির্যাতন ও ধর্ষণের মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনে করা মামলায় এখনো অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। অভিযুক্ত আসামিদের ধরার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকে ওই নারীর পাশে দাঁড়ান নারী অধিকার আন্দোলনকর্মী, নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ। তিনি বললেন, ‘এই নারীর সাহস দেখে আমরা তাঁর নাম দিয়েছি “সাহসিকা”। সে–ও ফোন করেই বলে, “আমি সাহসিকা বলছি।” প্রথম দেখা হওয়ার পর এই সাহসিকা বলেছিল, শুধু সে নয়, এ ঘটনায় পুরো দেশের নারীরা বিবস্ত্র হয়েছে।’

আর ওই নারী জানালেন, তিনি আগে মরার মতো বেঁচেছিলেন। তবে ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকে অনেক মানুষ তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি আশা করেন, শেষ পর্যন্ত সবাই তাঁর হাতটি ধরে থাকবেন।