স্বাস্থ্যবিমা চালু করতে অবকাঠামো গড়তে হবে

সৈয়দ আব্দুল হামিদ

স্বাস্থ্যের খরচ বৃদ্ধি সারা বিশ্বে উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর মূল কারণ: নতুন নতুন সংক্রমণ রোগের আবির্ভাব, বয়স্ক লোকের হার বৃদ্ধি, নতুন মেডিকেল টেকনোলজির উদ্ভাবন, এবং আধুনিক স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণে মানুষের চাহিদা বৃদ্ধি। কোভিড-১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাব পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করেছে। তাই স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়নে বিকল্প উৎসের সন্ধান করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিমা স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়নের একটা কার্যকরি পদ্ধতি হিসেবে বিশ্বে ব্যাপক সমাদৃত। কোভিড-১৯–এর মতো অতি সংক্রামক রোগের অর্থায়নের ক্ষেত্রেও এর কার্যকারিতা অনস্বীকার্য।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত মূলত সাধারণ রাজস্বনির্ভর সরকারি অর্থায়ন (২৩ শতাংশ) ও ব্যক্তিগত অর্থায়নের (৬৭ শতাংশ) ওপর নির্ভরশীল। স্বাস্থ্যবিমা মূলত কয়েকটি জীবনবিমা কোম্পানির জীবনবিমার সঙ্গে গোষ্ঠীগত স্বাস্থ্যবিমা হিসেবে চালু আছে। বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বাস্থ্যবিমার দায়িত্ব মূলত জেনারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানির হলেও হাতে গোনা দু-চারটা জেনারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ছাড়া এ ক্ষেত্রে কেউ এগিয়ে আসেনি। তাই বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়নে স্বাস্থ্যবিমার ভূমিকা ২–৩ শতাংশের বেশি নয়। আর সমগ্র বিমা খাতের অবদান মোট জাতীয় আয়ের ১ শতাংশেরও কম।

বাংলাদেশে প্রায় ১৫ কোটি মুঠোফোনের গ্রাহক রয়েছে। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ক্যানসার, কিডনি ডায়ালাইসিস, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকসহ বেশ কিছু ব্যয়বহুল রোগের চিকিৎসার অর্থায়ন সহজেই করা সম্ভব।

অথচ ভারতের বিশাল মোট জাতীয় আয়ের প্রায় ৪ শতাংশ বিমা খাতের অবদান। সামগ্রিক বিমাব্যবস্থায় বাংলাদেশ যে কতটা পিছিয়ে আছে, তার আরও প্রমাণ বিমা সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষের নেতিবাচক ধারণা। আর এই নেতিবাচক ধারণার জন্যই নিকট ভবিষ্যতে দেশে ঐচ্ছিক স্বাস্থ্যবিমা প্রচলন করা কঠিন। আবার ঐচ্ছিক স্বাস্থ্যবিমা ক্রয় করার সামর্থ্যও অনেকের নেই।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পরিচালিত অবদানমূলক (কন্ট্রিবিউটরি) সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা বা জাতীয় স্বাস্থ্যবিমা স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়নে একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি হিসেবে জার্মানি, ফ্রান্সসহ পশ্চিম ইউরোপের বেশ কিছু দেশ—দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, তাইওয়ান, ঘানাসহ পৃথিবীর অর্ধশতাধিক দেশে কার্যকরভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত অনেক বড় (৮৭.৫ শতাংশ) হওয়ার কারণে এবং কর-জিডিপি অনুপাত অনেক ছোট (৮.৭৫ শতাংশ) হওয়ায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সবার জন্য সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা এ মুহূর্তে চালু করা সম্ভব নয়। কেননা একদিকে বিপুলসংখ্যক লোক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত থাকায় স্বল্প খরচে প্রিমিয়ামের টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়, অন্যদিকে কর-জিডিপির হার কম হওয়ায় এত বিপুলসংখ্যক জনগণকে বিনা প্রিমিয়ামে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনার সক্ষমতা দেশের এখনো তৈরি হয়নি।

তবে স্বাস্থ্যবিমার ধারণা থেকে পুরোপুরি সরে আসাও ঠিক হবে না। সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে দেশে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত আছেন। তাঁদের সহজেই বাধ্যতামূলক কন্ট্রিবিউটরি স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা সম্ভব। তবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়েই শুরু করা যেতে পারে। ২০১২ সালে প্রণীত ২০ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ হেলথ কেয়ার ফাইন্যান্সিং স্ট্র্যাটেজিও সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাস্থ্যবিমা শুরু করার পরামর্শ দিয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের অর্থায়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায়, ৬৭ শতাংশ এবং ৮৯ শতাংশ সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী নির্ধারিত প্রিমিয়ামের যথাক্রমে ৫০ শতাংশ এবং ২৫ শতাংশ প্রদান করে রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত স্বাস্থ্যবিমায় অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক। ২০১৯ সালে ডিসি সম্মেলনেও সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালুর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করা হয়।

পর্যায়ক্রমে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ বেসরকারি খাতের কমপক্ষে ৩০ জনবলবিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেও এই বিমার আওতায় আনা যেতে পারে। আর প্রায় ৪২ লাখ পোশাকশ্রমিককে তো সহজেই বিমার আওতায় আনা যায়। উল্লেখ্য, এসএনভি নেদারল্যান্ডস ও একটি বায়ার্স প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বর্তমানে প্রায় ৪২ হাজার পোশাকশ্রমিক পরীক্ষামূলকভাবে বিমাসুবিধার আওতায় আছেন। সরকার, বিশেষ করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকনেতারা এগিয়ে এলে সব শ্রমিককে বিমাসুবিধার আওতায় আনা সহজতর হবে। এসব পরীক্ষামূলক প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন কেন্দ্রীয় তহবিল (সেন্ট্রাল ফান্ড) কর্তৃপক্ষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পের শ্রমিকদের জন্যও লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের উদ্যোগে ছোট পরিসরে একটি স্বাস্থ্যবিমা কার্যক্রম চালু রয়েছে। এর পরিসর বাড়িয়ে এ খাতের সব শ্রমিককে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা সম্ভব। তা ছাড়া দুই লক্ষাধিক চা–শ্রমিককেও স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা সম্ভব। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার লক্ষাধিক পরিচ্ছন্নতাকর্মীকেও স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা সম্ভব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের চারটি ভিন্ন ভিন্ন গবেষণায় এসব চিত্র ফুটে উঠেছে।

তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা যেতে পারে। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক বিমা কর্মসূচি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি বিভাগ বা ইনস্টিটিউটে চলমান আছে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনস কমিটির ২ জুন ২০২০ তারিখের সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩৭ হাজার শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এটি চালু হলে তা বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবিমার জগতে একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ভবিষ্যতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এ ধরনের বিমা চালু করলে বাংলাদেশে বিমা–সংস্কৃতির দ্বার উন্মোচিত হবে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায় যে বিমার আওতায় আসার পর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিমা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার পরিবর্তে ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই তাঁদের কর্মজীবনে এ ধরনের বিমার আওতায় আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। আর এই ছাত্রছাত্রীরাই তাঁদের কর্মজীবনে সবার জন্য স্বাস্থ্যবিমার প্রচলন ঘটাবেন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৪০ সালের আগেই রাষ্ট্রীয়ভাবে সবার জন্য স্বাস্থ্যবিমার প্রচলন করা সম্ভব হবে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের অর্থায়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায়, ৬৭ শতাংশ এবং ৮৯ শতাংশ সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী নির্ধারিত প্রিমিয়ামের যথাক্রমে ৫০ শতাংশ এবং ২৫ শতাংশ প্রদান করে রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত স্বাস্থ্যবিমায় অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক।

বাংলাদেশে প্রায় ১৫ কোটি মুঠোফোনের গ্রাহক রয়েছে। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ক্যানসার, কিডনি ডায়ালাইসিস, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকসহ বেশ কিছু ব্যয়বহুল রোগের চিকিৎসার অর্থায়ন সহজেই করা সম্ভব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৫ কোটি মুঠোফোন সাবস্ক্রাইবারের ওপর মাসে ২০ টাকা (বছরে ২৪০ টাকা) লেভি আরোপ করা হলে বছরে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকার প্রিমিয়াম সংগ্রহ করা সম্ভব, যা দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামোয় ব্যবহার করে যারা ক্যানসার, কিডনি ডায়ালাইসিস ও কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন করতে চায়, তাদের প্রত্যেককে বছরে ৫ লাখ টাকার বিমাসুবিধা দেওয়া সম্ভব।

স্বাস্থ্যবিমার এসব সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্যবিমা খাতকে এগিয়ে নিতে হলে এ খাতে বিদ্যমান সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলো দূর করতে হবে। বিমা সম্পর্কে মানুষের মনে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে হবে। বিমা খাতের ব্যবস্থাপনা কাঠামোর উন্নতি করতে হবে। বিমাশিল্পে কর্মরত লোকবলের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সর্বোপরি বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। তার জন্য এই কর্তৃপক্ষের সর্বস্তরে নিজস্ব জনবল নিয়োগ এবং তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সক্ষম করে তুলতে হবে।

স্বাস্থ্যবিমা চালু করতে হলে অন্যান্য দেশের মতো একটা শক্তিশালী অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য প্রথমে এ–সংক্রান্ত একটি যথাযথ আইন প্রণয়ন করতে হবে। আর এ আইনের আওতায় একটি শক্তিশালী জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশন বেনিফিট প্যাকেজ প্রণয়ন, প্রিমিয়াম নির্ধারণ, হাসপাতাল ইমপ্যানেলমেন্ট, ক্লেইম সেটেলমেন্টসহ স্বাস্থ্যবিমার যাবতীয় কাজ সম্পাদন করবে।


ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক