স্মারক সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই

নারীশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, সমাজে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি শত বছর আগেই বেগম রোকেয়া উপলব্ধি করেছিলেন।

বেগম রোকেয়ার হাতের লেখা চিঠি
সংগৃহীত

জাতীয় জাদুঘর স্থানসংকটের অজুহাতে নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ১০টি নিদর্শনের সব কটি প্রদর্শন করতে পারছে না। তারা তিনটি নিদর্শন প্রদর্শন করছে। তবে জাদুঘরে রোকেয়ার বড় একটি সাদাকালো ছবি স্থান পেয়েছে।

নারীশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, সমাজে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি শত বছর আগেই বেগম রোকেয়া উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর লেখনী ও নিজের জীবনে তা বাস্তবায়নও করেছেন। সেই রোকেয়া এখন নামফলক, ভবনের নাম বা দিবসের আনুষ্ঠানিকতায় আটকে আছেন।

১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দে জমিদার পরিবারে রোকেয়ার জন্ম। ১৯৩২ সালের এই দিনেই তিনি মারা যান। দিনটি রোকেয়া দিবস হিসেবে পালিত হয়। গতকাল বৃহস্পতিবারও নানা আনুষ্ঠানিকতায় দিবসটি পালিত হয়।

গত বুধবার রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরে গিয়ে দেখা যায়, একটি গ্যালারিতে কাচের বড় বাক্সে উনিশ শতকের শেষ ভাগে রোকেয়ার ব্যবহার করা একটি সুতি জামদানি শাড়ি ডিসপ্লেতে রাখা। এর সংগ্রহকাল ১৯৯৯ ও উপহারদাতা হিসেবে নারী অধিকারকর্মী আয়েশা জাফরের নাম লেখা। অন্য আরেকটি গ্যালারিতে রোকেয়ার হাতের লেখা চিঠি ও তাঁর স্কুলের হিসাবের একটি খাতা রাখা। চিঠির লেখা অস্পষ্ট হতে হতে এখন শুধুই একটি ধূসর কাগজ।

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা বিভাগের কিপার (পরিচালক) বিজয় কৃষ্ণ বণিক বলেন, রোকেয়ার ব্যবহার করা চীনামাটির দুটি ডিশ, একটি বয়াম, হাফ প্লেট, তরকারির ডিশ, কাচের লবণদানি, রুপার চামচ, শাড়ি, হাতের লেখা চিঠি ও একটি হিসাবের খাতা আছে জাদুঘরে। তবে জায়গার স্বল্পতায় শুধু শাড়ি, চিঠি ও খাতাটি ডিসপ্লেতে রাখা হয়েছে। অন্য নিদর্শনগুলো গুদামে রাখা। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ৩৮ নম্বর গ্যালারিতে রোকেয়ার নিদর্শনগুলো রাখা ছিল। উচ্চপর্যায়ের কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩৮ নম্বর গ্যালারিটিকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা হয়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে ১৯৯৩ সালে জাতীয় জাদুঘরকে রোকেয়ার স্মারকগুলো সংরক্ষণের জন্য দেওয়া হয়। রোকেয়ার বৈমাত্রেয় ভাইয়ের মেয়ে রণজিনা সাবের পায়রাবন্দে রোকেয়ার পৈতৃক ভিটার কাছাকাছি বাড়ি করেছেন। তিনি মহিলা পরিষদের সদস্যও। তিনিই রোকেয়ার স্মারকগুলো সংরক্ষণের জন্য উপহার হিসেবে মহিলা পরিষদকে দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তখনকার সহসভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মালেকা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আয়েশা জাফরের উদ্যোগে পায়রাবন্দ থেকে আমরা রোকেয়ার স্মারকগুলো সংগ্রহ করে জাদুঘরকে দিয়েছিলাম। একটি কর্নারে রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত ছিল। জায়গার অভাবে বা অজুহাতে রোকেয়াকে কোণঠাসা করে রাখা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নারী অধিকারকর্মীদের বিষয়টি নিয়ে আবার জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলা জরুরি।’

জানতে চাইলে রণজিনা সাবের বলেন, ‘জাদুঘর যথাযথ সম্মান দিয়ে রোকেয়ার স্মারক সংরক্ষণ করতে না পারলে তা আমাদের ফেরত দিক। পায়রাবন্দের যে সংগ্রহশালা আছে, তা–ও বেহাল—এখানেও স্মারক দিতে ভরসা পাই না।’

গত বছরের নভেম্বর মাসে সরেজমিনে রংপুরে গিয়ে দেখা যায়, রণজিনার বাড়িতে রোকেয়ার বাবার ছোট কোরআন শরিফ, লবণদানিসহ কিছু জিনিস সংরক্ষণ করেছেন।

রোকেয়ার দ্বিতীয় ভাইয়ের পৌত্রী অধ্যাপক মাজেদা সাবেরের ঢাকার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, রোকেয়ার তসবি, পানের বাটাসহ বিভিন্ন জিনিস সংরক্ষণ করে রাখা। রোকেয়ার উত্তরসূরি বইটি লিখেও ইতিহাস সংরক্ষণের চেষ্টা করেছেন তিনি।

রংপুরের পায়রাবন্দ ইউনিয়নের খোর্দ্দ মুরাদপুরে অবস্থিত রোকেয়া কমপ্লেক্সের একটি অংশে বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র। আরেকটি অংশে রোকেয়ার পৈতৃক ভিটা।

২০০১ সালের ১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩ দশমিক ১৫ একর জমির ওপর বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। স্মৃতিকেন্দ্রটি যাত্রা শুরু করেছিল বেগম রোকেয়ার জীবন ও কর্মকে সবার কাছে তুলে ধরা, তাঁর কাজ নিয়ে গবেষণা, তাঁর লেখা গ্রন্থের অনুবাদ, প্রচার এবং প্রকাশনার জন্য।

২০০৪ সাল থেকে পায়রাবন্দে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের উপপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন বাংলা একাডেমির উপপরিচালক আবদুল্যাহ আল-ফারুক। তিনি মুঠোফোন বলেন, ‘প্রায় চার কোটি টাকা খরচে স্মৃতিকেন্দ্রের ভবন তৈরি হয়েছিল। সংগ্রহশালার ধূলিমলিন কাচের আলমারিগুলোতে কখনোই কোনো স্মারক রাখা হয়নি। এসব নিয়ে চিঠিপত্র লিখছি দফায় দফায়।’

রোকেয়ার নিদর্শন জাদুঘরের স্টোরে রেখে দেওয়া প্রসঙ্গে আবদুল্যাহ আল-ফারুক বলেন, জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে তারা যেগুলো ডিসপ্লে করতে পারছে না, তা বাংলা একাডেমিকে দিয়ে দিতে বলা হয়েছে।

পায়রাবন্দে রোকেয়ার পৈতৃক ভিটার পাশেই ১৯৮৫ সাল থেকে যাত্রা শুরু করে বেগম রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগার। এ পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামের দাদি ছিলেন রোকেয়ার পরিবারের একজন সদস্য। রফিকুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘রোকেয়াকে সংরক্ষণের এখনো সময় আছে। সরকারকে শুধু একটু আন্তরিক হতে হবে।’