স্মৃতি-বিস্মৃতির ভাষা আন্দোলন

‘ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গিয়ে যদি শুধু ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন দিনের ঘটনাগুলোই বলা হয়, তাহলে সেটি হবে একটি আংশিক বিবরণ...’

বাংলা একাডেমি থেকে একুশের সংকলন ’৮০: স্মৃতিচারণ এবং একুশের সংকলন ১৯৮১: স্মৃতিচারণ নামে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮০–র দশকে।

সংকলন দুটির ঐতিহাসিক মূল্য ভাষা আন্দোলন বিষয়ে অন্য সব ইতিহাসগ্রন্থের চেয়ে কম নয়।

কারণ, এখানে যাঁরা স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁদের সবাই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের খুব গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব ছিলেন।

গ্রন্থ দুটির স্মৃতিচারণগুলো পড়লে ভাষা আন্দোলনের ওই দিনগুলোর স্পন্দন টের পাওয়া যায়।

লাঠিচার্জ আর কাঁদানে গ্যাসের ঝাপটা এসে লাগে পাঠকের শরীরে আর চোখেমুখে। জেল-জুলুম আর গুলি উপেক্ষা করে মিছিলে ঝাঁপিয়ে পড়ার উন্মাদনা বোধ করা যায়। কিন্তু সেসব অতিক্রম করে যেকোনো পাঠক পেয়ে যাবেন সেই মোক্ষম প্রশ্নটির উত্তরও, কেন তাঁরা ভাষা আন্দোলন করেছিলেন!

সেদিন কেন ভাষা আন্দোলন করেছিলেন ওই সময়ের ছাত্রজনতা! এর একটা আভাস লুকিয়ে আছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশনের বিতর্কের মধ্যে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি অধিবেশনটি বসে।

অধিবেশনে সেদিন বিরোধী দল কংগ্রেস দুটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল। প্রথম প্রস্তাবটি ছিল, বছরে অন্তত যেন একবার পাকিস্তান গণ-পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়।

দ্বিতীয়টি ছিল, ‘উর্দু এবং ইংরেজির সাথে বাংলাকেও যেন গণ-পরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়।

’ লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই সংশোধনী প্রস্তাব দুটির শেকড় পোঁতা আছে গণতান্ত্রিক চেতনার মধ্যে; জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠতার হিসাব-নিকাশের মধ্যে।

প্রথম প্রস্তাব পাকিস্তানি সাংসদরা তুড়ি মেরে বাতিল করে দেয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের তোলা দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবটি নিয়ে গণ-পরিষদ গরম হয়ে ওঠে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান অধিবেশনে দাঁড়িয়ে এহেন প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা ও নিন্দা করে তা অবিলম্বে বাতিল করার প্রস্তাব রাখেন।

কিন্তু কংগ্রেস দলের সেক্রেটারি রাজকুমার চক্রবর্তী সংশোধনী প্রস্তাবটির পক্ষে আলোচনা করতে গিয়ে মোক্ষম জায়গায় হাত দিয়ে বললেন, ‘উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশেরই কথ্য ভাষা নয়।

তা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের উপরতলার কিছুসংখ্যক মানুষের ভাষা। পূর্ব বাঙলা এমনিতেই কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচী থেকে অনেক দূরে, তার ওপর এখন তাদের ঘাড়ে একটা ভাষাও আবার চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।

একে গণতন্ত্র বলে না। আসলে এ হলো অন্যান্যদের উপর উচ্চশ্রেণির আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা।’ (বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, পৃ. ৫৩) এই তো ব্যাপার! গণতন্ত্র আর উচ্চশ্রেণি-নিম্নশ্রেণির মোড়কে বাঙালির আত্মমর্যাদার মামলা।

গণতন্ত্র আর আত্মমর্যাদা, এটাই তো ভাষা আন্দোলনের গোড়ার কথা। এই উদ্দেশ্যেই ভাষাসংগ্রামীরাও আন্দোলন করেছিলেন বলে বাংলা একাডেমির ওই সংকলনের অধিকাংশ ভাষাসংগ্রামী মত প্রকাশ করেছেন।

‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের’ প্রথম আহ্বায়ক নূরুল হক ভূঁইয়া তাঁর স্মৃতিচারণে বলেছেন, ‘পশ্চিম-পাকিস্তানী নেতাদের বা কর্মচারীদের কথাবার্তা, হাবভাব ইত্যাদি থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের অর্থাৎ পূর্ব-পাকিস্তানীদের স্বার্থ তো তারা সংরক্ষণ করবেই না, বরং আমাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য করবে। সে সময় আমরা বাংলা বললেই তারা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো।

...এ অবস্থার অবসানের জন্যে আন্দোলন ছাড়া আমাদের সামনে আর কোন পথ উন্মুক্ত দেখলাম না।’ (একুশের সংকলন ’৮০: স্মৃতিচারণ, পৃ. ৩১)

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত এদেশের যুব সমাজের আত্মমর্যাদা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে এক নিদারুণ আঘাত হিসেবে দেখা দেয়।

’ (একুশের সংকলন ১৯৮১: স্মৃতিচারণ, পৃষ্ঠা-৬৩) তিনি আরও বলেন, ‘বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না দিলে আমরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে যাব এবং চাকুরীর ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় অন্যদের কাছে হেরে যাবে।

’ ভাষা সংগ্রামীদের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, তাঁদের ভাষা আন্দোলনের মূল ব্যাপার ছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে পড়বার ভয় তথা আত্মমর্যাদাবোধ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলভিত্তি হিসেবে ধরা হয় ভাষা আন্দোলনের ওই গণতান্ত্রিক চেতনা আর আত্মর্যাদাবোধকে।

এর ভিত্তিতেই তো বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের জন্ম। কিন্তু এই রাষ্ট্রে বাংলা ভাষার সঙ্গে যুক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে নিয়ে কি মর্যাদাবান হতে পেরেছে! উচ্চ-আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ-শিক্ষা, উচ্চতর গবেষণা কোথাও বাংলার স্থান নেই।

ইংরেজির কদর দিনকে দিন রাষ্ট্রীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে গিয়ে বাঙালি ছাত্ররা চাকরি পাবে না বলে আশঙ্কা করেছিল।

উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে উর্দুভীতি নিয়ে তাদের পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো। বাংলাদেশের বাঙালি ছাত্রদের চাকরিক্ষেত্রে ইংরেজিভীতি নিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। বাংলাদেশের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মৌখিক পরীক্ষার প্রথম প্রশ্নই তো ‘ডেসক্রাইব ইয়োরসেল্ফ’! ইংরেজি অবশ্যই দরকার।

যার যেখানে যে কাজে ইংরেজি বা ফরাসি বা আরবি দরকার সে সেখানে শিখে নেবে এটাই তো সারা পৃথিবীর রেওয়াজ। কিন্তু নিজ ভাষাকে পাশ কাটিয়ে অন্য ভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে ‘মর্যাদাবান’ এবং ‘উন্নত’ হয়ে উঠেছে এমন রাষ্ট্র পৃথিবীর কোথায় আছে!

বাংলাদেশে বাংলা ভাষা অদ্যাবধি মর্যাদা আর আভিজাত্যের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেনি। সেটি চলে গেছে ইংরেজির দখলে।

ফেব্রুয়ারি মাস এলে ভাষা আন্দোলন ও ভাষা বিষয়ক বিচিত্র অনুষ্ঠান-আয়োজনে দেশ মেতে ওঠে।

কিন্তু সবই হয়ে থাকে নিছক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। অর্থবানের সন্তানকে বাংলা মাধ্যমে পড়ান না। যারা পারেন, তারা ইংরেজি ভার্শনে সন্তানকে পড়ান।

বাংলা একাডেমির ওই স্মৃতিচারণে ভাষা সৈনিক গাজীউল হক বলেছেন, ‘ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গিয়ে যদি শুধু ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন দিনের ঘটনাগুলোই বলা হয়, তাহলে সেটি হবে একটি আংশিক বিবরণ।

কারণ ভাষা আন্দোলন যেমন এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে, এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছে, পরিপুষ্ট করেছে, ঠিক তেমনি এ দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে যে সমস্ত গণতান্ত্রিক সংগঠন জন্ম নিয়েছিলো- সে সব সংগঠনগুলোও ভাষার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে সাহায্য করেছে।’ (একুশের সংকলন ’৮০: স্মৃতিচারণ, পৃষ্ঠা-৯৭)

বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার যথাযথ প্রতিষ্ঠায়ন না ঘটার পেছনে যেমন বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সরকারগুলোর দায় রয়েছে, আবার যতটুকু সীমিত আকারে বাস্তবায়িত হয়েছে তার জন্যও বিভিন্ন সরকারের একটা মাত্রার সদিচ্ছাও কাজ করেছে নিশ্চই।

ফলে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠায়নে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত বেশি জরুরি। রাষ্ট্র যত দ্রুত ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যানুগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, ততই রাষ্ট্রের পক্ষে এবং জাতীয় মর্যাদাবোধের পক্ষে মঙ্গল।

কুদরত-ই-হুদা: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শ্রীনগর সরকারি কলেজ, মুন্সীগঞ্জ