স্মৃতিতে বিশ্লেষণে বঙ্গবন্ধু

  • আলাপচারিতার উপলক্ষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: কাছে থেকে দেখা বইটি, অধ্যাপক নুরুল ইসলামেরই লেখা।

  • বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ১৯৬৯ সালে নুরুল ইসলাম যখন তাঁর সঙ্গে যুক্ত হলেন, বঙ্গবন্ধুর তখন বাঙালির প্রধান জননেতা হিসেবে অভিষেক ঘটেছে।

  • নুরুল ইসলামের বইটির সূত্র ধরে তিন আলোচকের কথায় উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর জীবনের আরও নানা প্রসঙ্গ।

নুরুল ইসলাম, আবুল মোমেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

সংযোগটি ঘটল অভূতপূর্ব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা একটি বইকে ঘিরে। প্রথম আলোর ফেসবুক লাইভে ২২ অক্টোবর রাত ১০টায় সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুক্ত হলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। ৯২ বছর বয়সী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য–ধন্য, স্বাধীনতার পরে প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করার সুবাদে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উন্মেষকালের নিবিড় প্রত্যক্ষদর্শী তিনি।

‘বঙ্গবন্ধু: ফিরে দেখা’ শিরোনামের সে আলাপচারিতায় আরও যুক্ত হন লেখক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সংগঠক আবুল মোমেন। তিনি যোগ দেন চট্টগ্রাম থেকে। ঢাকা থেকে যুক্ত হন কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। এই প্রতিবেদকের সঞ্চালনায় ১ ঘণ্টা ২৫ মিনিটের সেই আলাপচারিতায় উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিশেষ কিছু পর্ব, তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য, বাংলাদেশের ইতিহাসের পটে তাঁর নানা অবদানের গুরুত্ব। আলাপচারিতার উপলক্ষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: কাছে থেকে দেখা বইটি, অধ্যাপক নুরুল ইসলামেরই লেখা। বইটি বেরিয়েছে এ বছর, প্রথমা প্রকাশন থেকে। এ বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ। দেশজুড়ে তার নানা উদ্‌যাপন চলছে। কিন্তু নুরুল ইসলামের এই স্মৃতি ও মূল্যায়নধর্মী বইয়ের প্রকাশ এবং সে উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে আলোচনার মাত্রা ছিল আলাদা।

বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ১৯৬৯ সালে নুরুল ইসলাম যখন তাঁর সঙ্গে যুক্ত হলেন, বঙ্গবন্ধুর তখন বাঙালির প্রধান জননেতা হিসেবে অভিষেক ঘটেছে। ছয় দফা সবার প্রাণের দাবি। স্বাধিকারের আন্দোলন দ্রুতই স্বাধীনতার দাবির দিকে ধাবিত হবে। অধ্যাপক নুরুল ইসলামসহ অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন ও অধ্যাপক আনিসুর রহমানের মতো অর্থনীতিবিদদের বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব দিয়েছেন ছয় দফার ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ করতে, রাজনীতিবিদ ও জনমানুষের কাছে তার মর্ম তুলে ধরতে এবং ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে একটি ভবিষ্যৎ সংবিধানের খসড়া তৈরি করতে।

নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যুক্ত হলেন এবং যুক্ত হয়ে থেকে গেলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বসালেন এর ডেপুটি চেয়ারম্যান পদে। নুরুল ইসলাম প্রণয়ন করলেন দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। তাঁর বই এবং ফেসবুক লাইভে আলাপচারিতার বিষয় ছিল তারই স্মৃতি ও বিশ্লেষণ।

রাজনীতির আঙিনায় পেশাজীবী

রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পেশাজীবী নুরুল ইসলাম কাজ করতে শুরু করলেন কী করে? এর উত্তরে তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর কোনো পরিচয় ছিল না। ১৯৬৯ সালে তাঁর বন্ধু পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের গভর্নর এম রশচিদ তাঁকে জানালেন, বঙ্গবন্ধু তাঁকে দেখা করতে বলেছেন। কিছুটা আশ্চর্য হয়েই তিনি দেখা করলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বললেন, ‘আপনার সাহায্য আমি চাই। ছয় দফা বাস্তবায়ন করতে গেলে কী কী বিষয় আমাদের সামনে আসবে, অন্য অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে নিয়ে সেটা বোঝান। পাকিস্তানিদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য এটা আমাদের জন্য দরকার।’

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম কাজে যোগ দিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতা হলো মধুর। যেকোনো শিক্ষককেই বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সম্মান দিয়ে কথা বলতেন এবং সমান মর্যাদা দিতেন। তাঁদের সে কাজে একটি কমিটি তৈরি হলো। তাতে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহকর্মীদের মধ্যে থাকলেন তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোশতাক আহমদ প্রমুখ। অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে অন্য বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন মোজাফফর আহমদ ও খান সারওয়ার মুরশিদ।

অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচন পর্যন্তও সবাই ছয় দফার তাৎপর্য বুঝে উঠতে পেরেছিলেন কিনা সন্দেহ। কারণ, ছয় দফা কার্যত প্রায় স্বাধীনতা।

আবুল মোমেন বলেন, ১৯৬৯ সালের গণ–আন্দোলনের পর কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়ে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠন করেন। সে সময়ে অনেক নতুন লোক দলে ঢোকেন। ছয় দফার প্রতি তাঁদের আস্থা ও অঙ্গীকার কতটা, তা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সংশয় ছিল। সে কারণে তাঁদের নিয়ে তিনি পল্টনে একটি শপথ অনুষ্ঠান করেন। নুরুল ইসলামের বইয়ে এর অনুপম বিবরণ আছে। তিনি বলেন, ‘দলের মধ্যে বঙ্গবন্ধুই জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণভাবে বুঝতে পেরেছিলেন এবং সেভাবে এগিয়ে চলেছিলেন।’

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাঁর আলোচনায় বলেন, স্বাধীনতার আগে পূর্ববঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থা বৈষম্যের কারণে দুর্বল। অধিকাংশ মানুষ শিক্ষাবঞ্চিত। সেই জাতিকে স্বাধীন বাংলাদেশের এই অবস্থানে নেওয়ার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবদান সবচেয়ে বেশি। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম তাঁর বইয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের পর্যালোচনা করেছেন।

সদ্য স্বাধীন দেশে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: কাছে থেকে দেখা নুরুল ইসলাম প্রথমা প্রকাশন

নুরুল ইসলামের বইটির সূত্র ধরে তিন আলোচকের কথায় উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর জীবনের আরও নানা প্রসঙ্গ। প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের অভিজ্ঞতা, বঙ্গবন্ধুর অসামান্য স্মৃতিশক্তি, পররাষ্ট্র বিষয়ে তাঁর জাতীয় স্বার্থভিত্তিক অবস্থান, তাঁর সময়কার বিরোধী রাজনীতিবিদদের প্রতি সহৃদয় আচরণ এসব নিয়েও আলোচকেরা কথা বলেন ।

প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে নুরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের নতুন সরকার ছিল একটি প্রাদেশিক সরকারের উত্তরাধিকার, কোনো কেন্দ্রীয় সরকারের নয়। সে কারণে পররাষ্ট্রের মতো মন্ত্রণালয় বা পরিকল্পনা কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা তাঁদের ছিল না। কমিশনের সামনে বাধার অন্যতম উৎস ছিল সেটি।

নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পরস্পর সম্পর্কিত কাজের সুরাহা আমাদের করতে হতো । এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক মন্ত্রণালয়ের তখনো সক্ষমতা তৈরি হয়নি। কমিশন প্রকল্প অনুমোদন করত এবং সাহায্য করত। বঙ্গবন্ধু সহযোগিতা করলেও তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাদে অন্য মন্ত্রণালয়ের জনপ্রতিনিধিরা এটা বুঝতে চাইতেন না এবং এটা পছন্দ করতে পারেননি।’ তবে আত্মসমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আমরাও জনপ্রতিনিধিদের বোঝানোর মতো দক্ষতা অর্জন করে উঠিনি বা পর্যাপ্ত সময় দিতে পারিনি।’

বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্র বিষয়ে বলতে গিয়ে আবুল মোমেন বলেন, নুরুল ইসলাম তাঁর বইয়ে যেসব ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন তাতে এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর গভীর প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরোধিতা এবং স্বাধীনতার পরপর স্বীকৃতি না দেওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে থেকে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল ও তাঁর সহকর্মীদের বঙ্গবন্ধু কূটনৈতিক মর্যাদা দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার জন্য ভারতের উদার প্রশংসা সত্ত্বেও ফারাক্কা বাঁধ ও সীমান্ত বাণিজ্য প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্বার্থের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। জোট–নিরপেক্ষ আন্দোলনের পক্ষে তাঁর সমর্থন ছিল আন্তরিক।

বর্তমান রাজনীতিবিদদের বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বহু কিছু নেওয়ার আছে বলে মনে করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কখনোই গজদন্ত মিনারে বসে রাজনীতি করেননি। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন তৃণমূলের রাজনীতিবিদ। জনগণের মনের আকাঙ্ক্ষা তিনি পড়তে পারতেন এবং রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ কোনদিকে যাবে সেটা বুঝতে পারতেন। সেভাবেই তিনি মানুষের আকাঙ্ক্ষা আর রাজনৈতিক বাস্তবতাকে যুক্ত করতেন।

আলোচনার মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ইতিহাস আর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মধারার কথা ফিরে আসে বারবার। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম আলোচনার মাঝখানেই তুলে দেখান তাঁর লেখা আরও একটি বই ইন্ডিয়া পাকিস্তান বাংলাদেশ: আ প্রাইমার অব পলিটিক্যাল হিস্ট্রি। বলেন, ‘এই উপমহাদেশে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের তাৎপর্য আমাদের বুঝে দেখা প্রয়োজন। এ বইটি হয়তো তাতে সাহায্য করতে পারে।’ প্রসংগত, গত বছর প্রকাশিত এ বইয়ের প্রকাশকও প্রথমা প্রকাশন।

আলোচনা শেষ হয়ে আসে। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর সামনে এ আলোচনার অর্থবহ রেশ থেকে যায়।