স্যানিটেশনে অসম্ভব অর্জন

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণ যখন স্বাধীনতার সংগ্রামে লিপ্ত সময় শতকরা কতটি বাড়িতে ল্যাট্রিন ছিল? শতকরা কত পরিবার নিরাপদ সুপেয় পানি পান করত? এই প্রশ্ন দুটির উত্তর দিতে যাঁরা সাধারণ জ্ঞানে চৌকস সম্ভবত তাঁরাও খানিকটা থমকে যাবেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এই প্রশ্ন দুটির উত্তর আমাদের জানিয়ে দেবে বাংলাদেশে পানি স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি খাতের অনন্য অর্জন।

গত দুই দশকে কিছু আর্থসামাজিক নিয়ামক স্যানিটেশনের সাফল্যে অবদান রেখেছে
ছবি: প্রথম আলো

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ল্যাট্রিন ছিল শতকরা ১ ভাগেরও কম বাড়িতে। সারা দেশে টিউবওয়েল ছিল দুই লাখেরও কম। ঢাকা-চট্টগ্রাম শহরসহ মাত্র ৭৬টি পৌরসভায় ছিল পাইপ দিয়ে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা। অর্থাৎ স্বাধীনতার সংগ্রামের সময় এবং শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে পানি ও স্যানিটেশনের অবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় ছিল।

২০২১ সালের ১ জুলাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের যৌথ কর্মসূচি পৃথিবীর সব দেশের পানি ও স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্য আচরণবিধি নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায় ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে এখনো ১৫ শতাংশের ওপরে মানুষ খোলা মাঠে পায়খানা করে। অথচ বাংলাদেশ ২০১৫ সালের মধ্যেই খোলা মাঠে পায়খানার হারকে শূন্যে নামিয়ে এনেছে এবং গত পাঁচ বছর শূন্য হারকে ধরে রেখেছে।

১৯৭১ সালে স্যানিটেশনের এমন নাজুক অবস্থা থেকে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াল বাংলাদেশ? এই ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনেও রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ। সে সময় বাংলাদেশ থেকে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।

শরণার্থী শিবিরগুলোর অনেকগুলোই স্থাপিত হয়েছিল নিম্ন জলাভূমিতে, শরণার্থীদের সুবিধার্থে খাল-বিল-নদী-নালার কাছাকাছি। একই পানি দিয়ে খাওয়াদাওয়া, গোসল করা, শৌচকাজ করা ইত্যাদির ফলে বর্ষা মৌসুমে খুব দ্রুতই শরণার্থী শিবিরে কলেরা ছড়িয়ে পড়ে।

কলেরায় কত লাখ শরণার্থী মারা গেছে, তা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। ভারত সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় কলেরা নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশে পানি ও স্যানিটেশনের গুরুত্ব স্বাধীনতাযুদ্ধে শরণার্থী শিবিরে জীবনের বিনিময়ে অর্জিত।

প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পানি এবং স্যানিটেশনকে মৌলিক চাহিদার অংশ এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও রোগব্যাধি নিয়ন্ত্রণে অত্যাবশ্যকীয় ভাবা হয়েছিল।

সত্তর দশকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে নলকূপ প্রচলনের উদ্যোগ নেয়। এর পাশাপাশি ইউনিসেফ প্রদত্ত ভর্তুকি দিয়ে স্যানিটারি ল্যাট্রিন বিতরণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়। নলকূপের ব্যাপারে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও স্যানিটারি ল্যাট্রিনের ব্যাপারে কেন যেন খুব একটা সাড়া পাওয়া যায়নি।

আশির দশককে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিকভাবে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশনের দশক হিসেবে ঘোষণা করে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সারা দেশের সব কটি থানায় স্যানিটারি ল্যাট্রিনের উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপন করে ভর্তুকিমূল্যে বিতরণ করতে শুরু করে।

রিং এবং স্ল্যাবকে অনেক ব্যয়সাশ্রয়ী করে তোলা হয়; পাশাপাশি নলকূপ গ্রহণের জন্য ১০ জনের গ্রুপ গঠন এবং সবার ল্যাট্রিন থাকাকে পূর্বশর্ত হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। এ সময় বেসরকারি খাতেও স্যানিটারি ল্যাট্রিন এবং টিউবওয়েলের উৎপাদন শুরু হয়। ক্ষুদ্রঋণ প্রদানে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্র্যাক গ্রামাঞ্চলে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তারাও তাদের সদস্যদের ল্যাট্রিন গ্রহণকে গৃহঋণের অংশ বা পূর্বশর্ত করে।

এসব উদ্যোগের ফলে আশির দশকে স্যানিটেশনের হার কিছুটা বাড়ে। ১৯৯১ সালে নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশনের পরিস্থিতি যাচাই করতে প্রথম দেশব্যাপী একটি সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় যে ৪০ শতাংশ মানুষ খোলা মাঠে পায়খানা করছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর নব্বইয়ের দশকে এসে তাদের কর্মকৌশল পাল্টায়। ভর্তুকিমূল্যে বিতরণের চেয়ে তারা সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণে মনোযোগী হয়। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক এনজিওরাও সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণে নানা ধরনের উদ্ভাবন নিয়ে এগিয়ে আসেন।

২০০০ সালে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার মসমইল গ্রামের প্রায় অর্ধেক মানুষ খোলা মাঠে পায়খানা করত।

তাদের বিবমিষা-জাগানিয়া এক অঙ্ক কষার মাধ্যমে অনুধাবন করানো হয় যে খোলা মাঠে পায়খানা মানে নিজের ‘গু’ নিজে খাওয়া। এই অনুধাবনের পরিপ্রেক্ষিতেই কয়েক মাসের মধ্যে মসমইল গ্রামের ঘরে ঘরে ল্যাট্রিন হলো; এবং তারপর সবাই মিলে গ্রামের সামনে একটি সাইনবোর্ড টানিয়ে দিলেন “এই গ্রামের কেউ খোলা মাঠে পায়খানা করে না”।

বিশ্বব্যাংকের পানি ও স্যানিটেশন কর্মসূচির বদলৌতে মসমইল গ্রামের অসামান্য ঘটনার নানা উন্নয়ন ও সংস্করণ বাংলাদেশে ঘটতে শুরু করে; এবং পরে এই প্রক্রিয়া পৃথিবীর ৬০টি দেশে অনুসরণ করে স্যানিটেশনের প্রসার ঘটে।

নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে সব ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন নিজেরা স্যানিটেশনের অবস্থা জানতে সমীক্ষা করল; পরিকল্পনা করল।

পানি ও স্যানিটেশন এমডিজির একটি সূচক হিসেবে স্বীকৃত হলে যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড ও ডেনমার্ক সরকার ইউনিসেফ, ওয়াটারএইড, ব্র্যাকসহ কয়েকটি বড় বড় এনজিওকে সামগ্রিক সমাজভিত্তিক স্যানিটেশন নিশ্চিত করার জন্য কয়েকটি বড় বড় প্রকল্পের অর্থায়ন করেন, যা দিয়ে দেশের প্রায় অর্ধেক উপজেলায় এই এনজিওগুলো স্যানিটেশন প্রসারে কাজ করতে পেরেছে।

স্থানীয় সরকার বিভাগ এই সামাজিক আন্দোলনের সফল নেতৃত্ব দিয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌরসভাকে তাদের বার্ষিক থোক বরাদ্দ থেকে ২০ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্যানিটেশনের জন্য বরাদ্দ করার নির্দেশ দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক স্যানিটেশন নিশ্চিত করেছে। সরকারের এই নীতির কারণেই উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশ দরিদ্র এবং হতদরিদ্রদের মধ্যে স্যানিটেশনের হার অন্য দেশগুলোর চেয়ে বেশি ছিল।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জাতীয় স্যানিটেশন টাস্কফোর্স গঠন করে সবাইকে নীতি নির্ধারণের অংশীজন বানিয়েছে; নিয়মিত পর্যালোচনা সভা করে দেশে স্যানিটেশনের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে দিকনির্দেশনা দিয়েছে।

প্রতিবছর অক্টোবর মাসকে জাতীয় স্যানিটেশন মাস হিসেবে উদ্​যাপন করার ব্যবস্থা করেছে, যাতে করে এ মাসে প্রতিবছরের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে সামনের বছরের জন্য পরিকল্পনা করা যায়। প্রায় ১৮ বছর ধরে এই ধারা অব্যাহত আছে।

২০০৯ সালে সরকার ক্ষমতায় এসে পানি ও স্যানিটেশন খাতের বাজেটে প্রায় ৬০ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে ব্যাপক একটি উল্লম্ফন ঘটায় এবং পরের বছরগুলোতে খানিকটা ব্যত্যয় সত্ত্বেও বাজেট বরাদ্দে স্থিতাবস্থা বজায় আছে।

এর মূল কারণ ছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি। কাজেই বাংলাদেশের স্যানিটেশনের সাফল্যের মূল চালিকা শক্তি হলো রাজনৈতিক নেতৃত্বের সক্রিয় অংশগ্রহণ।

গত দুই দশকে আরও কিছু আর্থসামাজিক নিয়ামক স্যানিটেশনের সাফল্যে অবদান রেখেছে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি, বিদ্যুৎ, মুঠোফোন এবং টেলিভিশনের প্রসার, এবং সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অব্যাহত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এসব নিয়ামকের অন্যতম। তবে ছাত্রী উপবৃত্তির মাধ্যমে নারীশিক্ষার প্রসার, গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্রঋণের নারীকেন্দ্রিক প্রসার, এবং সার্বিকভাবে নারীর ক্ষমতায়নের কারণে কোনো কিশোরী বা নারী আর এখনকার বাংলাদেশে খোলা মাঠে মলত্যাগে যাবে না।

যে হারে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেড়েছে; বাড়ির আশপাশে ঝোপঝাড় বিলুপ্ত হয়েছে; শহরের বস্তিতে জনসংখ্যার যে ঘনত্ব, তাতে করে খোলা মাঠে মলত্যাগের কথা এখন আর ভাবাই যায় না; নারীদের ব্যক্তিগত সম্ভ্রম এখানে মুখ্য। বাংলাদেশে স্যানিটেশনের অর্জন নারীদের সম্ভ্রম রক্ষায় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

২০২১ সালের জুলাই মাসের বৈশ্বিক প্রতিবেদনে পানি ও স্যানিটেশন নিয়ে পৃথিবীর ২৩০টি দেশের তথ্য আছে। অথচ হাইজিন নিয়ে তথ্য দিতে পেরেছে মাত্র ৫৩টি দেশ, যার অন্যতম বাংলাদেশ।

আর নারীদের মাসিক স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্য দিতে পেরেছে মাত্র ৪১টি দেশ। এর মধ্যে কেবল দুটি দেশ মিসর ও বাংলাদেশ মাসিকসংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে পেরেছে।

এই গর্বের অর্জন সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় হাইজিন সার্ভে ২০১৮ সম্পাদনের কারণে। উল্লেখ্য, হাইজিন নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে এমন সমীক্ষাও পৃথিবীতে বিরল।

তবে পানি ও স্যানিটেশন খাতে বাংলাদেশের এসব অর্জন প্রধানত আচরণ পরিবর্তনজনিত অন্তর্বর্তী অর্জন।

একে পুঁজি করে এসডিজি অর্জনে এগিয়ে যাওয়া উচিত। কোভিডের প্রকোপকালে আমরা জনগণকে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া শিখিয়েছি কলের প্রবাহমান পানি দিয়ে। অথচ বাংলাদেশের গ্রামে মাত্র ৩ শতাংশ ঘরে পাইপ সংযোগে কলের পানি আছে; সারা দেশে এই হার ১৫ শতাংশ; যা আফগানিস্তানের চেয়েও কম।

আমাদের হাত ধোয়া শেখানো কতখানি দারিদ্র্যবান্ধব বা গ্রামীণ পরিবেশের জন্য উপযোগী, তা গবেষণার বিষয়। সময় এসেছে, উন্নয়নে সমসুবিধার কথা ভাবার; কাউকে পেছনে ফেলে নয়, তা নিশ্চিত করার।

২০২১-এর বৈশ্বিক প্রতিবেদন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে আশপাশের দেশগুলো টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) প্রথম পাঁচ বছরে নিরাপদ স্যানিটেশনের কয়েকটি সূচকে আমাদের ছাড়িয়ে গেছে।

তারা তা করেছে শহর-গ্রামনির্বিশেষে স্যানিটেশনের অবকাঠামোতে আগ্রাসী বিনিয়োগ করে। বাংলাদেশেরও দরকার দরিদ্র ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা। সাধারণ মানুষ স্যানিটেশনে তাঁদের আচরণ পরিবর্তন করেছেন কোনো না কোনো ল্যাট্রিন তাঁরা ব্যবহার করেন।

সরকারের উচিত তাদের ল্যাট্রিনকে মানসম্মত করে নিরাপদ সুব্যবস্থাসম্পন্ন করার। এসডিজি অর্জন নিশ্চিত করতে দারিদ্র্যবান্ধব সরকারের কাছে এই আমাদের প্রত্যাশা।


খায়রুল ইসলাম: ওয়াটারএইডের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক