হতদরিদ্রদের উন্নয়নের প্রকল্পে লুটের অভিযোগ

নদীভাঙা মানুষের উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্পের টাকা কাজ না করেই তুলে নেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে।

বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ)
ছবি : সংগৃহীত

বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলায় প্রতিবছরই ভাঙে যমুনা নদী। প্রতিবছরই সর্বস্ব হারানোর তালিকায় নাম লেখান এখানকার অনেক মানুষ। ভাঙনকবলিত ছয়টি ইউনিয়নের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পারিবারিক আয়বৃদ্ধি, আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে গড়ে তুলতে ২০১৭ সালের ১ জুন থেকে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ৩০ কোটি ৫৫ লাখ ৭০ হাজার টাকার এই প্রকল্পে লুটপাট ও অনিয়মের কিছু বিষয় উঠে এসেছে সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে।

বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলার চর এলাকায় বসবাসরত ‘দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে প্রকল্পটি হাতে নেয় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার ও সমবায় বিভাগ। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল গত ৩০ জুন পর্যন্ত, পরে আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

প্রকল্প ঘুরে দেখে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের কর্মকর্তা মোহাম্মদ হামিদুর রহমান ৩ ডিসেম্বর পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগে তাঁর মূল্যায়ন প্রতিবেদন জমা দেন। ১১ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে সরকারি প্রকল্পে এমন জালিয়াতি ও লোপাটের জন্য প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় এনে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

তবে প্রকল্পটির পরিচালক ও আরডিএর পরিচালক (প্রশিক্ষণ) সমীর কুমার সরকার বলেন, ‘প্রতিবেদনটি মনগড়া এবং বাস্তবতা বিবর্জিত।’একডেমির সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তাও ওই মূল্যায়ন প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন।

এর আগেও আরডিএর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রকল্পে লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে, তবে কারও কিছু হয়নি। ‘পল্লী জনপদ’ নামে একটি প্রকল্পে লুটপাটের অভিযোগ আরডিএর সাবেক ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক এম এ মতিন, প্রকল্প পরিচালক মাহমুদ হোসেন খানসহ সাতজনের বিরুদ্ধে গত বছরের এপ্রিলে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের সহকারী পরিচালক আমিনুল ইসলাম গতকাল বলেন, সেই মামলাটি তদন্তাধীন। মামলার পর আরডিএর পরিচালক মাহমুদ হোসেন আমেরিকায় পালিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক এম এ মতিন গত বছরই অবসরে গেছেন। গত ২১ মার্চ কয়েক হাজার কোটি টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে এম এ মতিন ও তাঁর স্ত্রী সাবিনা আফরোজের সম্পদের হিসাব চেয়ে চিঠি দেয় দুদক। তাঁর বিরুদ্ধে প্রচুর স্থাবর–অস্থাবর সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। মামলার আসামি আরডিএর সহকারী পরিচালক আরিফ হোসেন উচ্চশিক্ষা নিতে এখন জাপানে। বাকিরাও চাকরিতে বহাল রয়েছেন।

যা আছে মূল্যায়ন প্রতিবেদনে

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের প্রস্তাবে (ডিপিডি) সুফলভোগীদের মাধ্যমে ৯ হাজার ৩২টি ফলদ চারা রোপণের কথা ছিল। প্রতিটি চারায় ১০০ টাকা খরচ ধরা হয়েছিল। কিন্তু গত অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৯৩২টি চারা বিতরণ করে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১০ লাখ টাকা। প্রতিটি চারার গড় ব্যয় ১ হাজার ৭২ টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পে স্যাটেলাইট স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপন না করেই ৪৫ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গবাদিপশুর কৃত্রিম প্রজননের জন্য দুটি ইউনিটে ৮৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু কৃত্রিম প্রজনন ইউনিট স্থাপন না করেই এ খাতে অক্টোবর পর্যন্ত ৭৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। ৩০টি সাইলেজ চপিং মেশিন (পশুখাদ্য প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্র), চরে চলাচল উপযোগী আটটি নছিমন বা ভটভটি ক্রয়সহ অন্য খাতে ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু ভটভটি ও সাইলেজ চপিং যন্ত্র না কিনেই সব অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে। দুগ্ধ বাজারজাতকরণ ও উদ্যোক্তা তৈরিতে ৮টি ইউনিট স্থাপনে ১ কোটি ৫৫ লাখ ৫৭ টাকা বরাদ্দ ছিল। অথচ মাত্র দুটি ইউনিট স্থাপন করেই সব টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। ৩০০ পরিবারকে হস্তচালিত অগভীর নলকূপ সরবরাহের জন্য ৬২ লাখ ১৩ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল। কোনো নলকূপ স্থাপন না করেই পুরো অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে। চরাঞ্চলে সৌরবিদ্যুৎ ও পাইপের মাধ্যমে ১ হাজার ২০০ পরিবারে পানি সরবরাহের জন্য ২ কোটি ২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু বাস্তবে দুটি সৌরবিদ্যুৎ–চালিত গভীর নলকূপ ও ট্যাংক নির্মাণেই ২ কোটি ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ খাতে ঠিকাদারের দেওয়া দরের চেয়ে ২০ লাখ ৫ হাজার টাকার বেশি ব্যয় করা হয়েছে। দেড় হাজার পরিবারকে পায়খানা নির্মাণ করে দেওয়ার জন্য ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। ৪৮৯টি পরিবারকে পায়খানা তৈরি করে দিয়ে এ খাতে শতভাগ অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিমূল্যের চেয়ে ১৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা বেশি অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নানা খাতে আরও বেশ কিছু অনিয়ম ও অসংগতি উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য

প্রকল্পের পরিচালক সমীর কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ওই মূল্যায়ন প্রতিবেদন দাখিলের জন্য একজন যুগ্ম সচিবকে সরেজমিনে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ২০ ডিসেম্বর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে গেছেন। এ ছাড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির পক্ষ থেকেও অতিরিক্ত মহাপরিচালক সুফিয়া নাজিমকে প্রধান করে আরেকটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। তাঁরাও প্রকল্প এলাকা ঘুরে এসেছেন। দুটি তদন্ত দলই প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পায়নি। তা ছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ শেষের আগে লুটপাটের প্রশ্ন উঠছে কেন?

জানতে চাইলে বগুড়া আরডিএর অতিরিক্ত মহাপরিচালক সুফিয়া নাজিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরেজমিনে প্রকল্প এলাকা ঘুরে বড় অনিয়ম–দুর্নীতি চোখে পড়েনি। মূল্যায়ন কর্মকর্তা এক দিনের নোটিশে সরেজমিনে এসে সব নথি দেখতে চেয়েছেন। এতে সময়মতো প্রকল্প পরিচালক যাবতীয় নথি হয়তো তাঁকে দেখাতে পারেননি।’

প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি প্রসঙ্গে মূল্যায়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হামিদুর রহমান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্পের সিংহভাগ অর্থই তো কাজ না করে তুলে নিয়েছেন, প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি না হলে তাঁরা কী করতেন?’